বিভিন্ন অঙ্গতন্ত্রের পারস্পরিক সহযোগিতামূলক কাজের মাধ্যমে দেহের সকল কর্মকান্ড সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হওয়ার প্রক্রিয়াকে সমন্বয় (coordination)বলে।
স্নায়বিক সমন্বয় (Nervous Coordination):
উদ্দীপনায় সাড়া দেওয়ার ক্ষমতা প্রতিটি জীবের মৌলিক বৈশিষ্ট্য। বিবর্তনের গতিপথে এককোষী জীব যখন এক সময় বহুকোষী জীবে পরিণত হয়েছে তখন দেহের সবখানে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গে ছড়িয়ে থাকা অগণিত কোষের বৈচিত্র্যময় স্বতন্ত্রে পৌঁছায়। ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে যোগসূত্র রচনা করা এবং পরিবেশের সাথে সুসম্পর্ক রক্ষা করার উদ্দেশে আবির্ভূত হয়েছে দ্রুত যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণকারী স্নায়ুতন্ত্র । স্নায়ুতন্ত্র এমন এক বিশেষ অঙ্গতন্ত্র যা দেহের অন্যসব অঙ্গতন্ত্রের কাজে অন্যতম প্রধান সমন্বয়ক ও নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে ।মানুষের স্নায়বিক সমন্বয়ের প্রধান সমন্বয়কারী স্নায়ুতন্ত্রের গঠন ও কার্যকরী একক হচ্ছে নিউরন নিউরনের দুটো প্রধান অংশ হচ্ছে কোষদেহ (cell body) এবং প্রলম্বিত অংশ বা নিউরাইট (ncurite)। নিউরাইটকে আবার দুভাগে ভাগ করা হয়েছে- বহু শাখা-প্রশাখা বিশিষ্ট ছোট ছোট প্রলম্বিত অংশ বা ডেনড্রাইট (dendrite) এবং শাখা-প্রশাখা বিহীন দীর্ঘ প্রলম্বিত অংশ বা অ্যাক্সন (axone)।
১. নিউরন (Neurone):
নিউরন পাঁচ ধরনের-
ক.মেরুহীন (Apolar) – ডেনড্রাইট ও অ্যাক্সন নেই । খ.একমেরুযুক্ত-(Unipolar) - একটিমাত্র অ্যাক্সন ।
গ.ছদ্ম-মেরুযুক্ত (Pseudo-unipolar) - ডেনড্রাইট ও অ্যাক্সন একটি দন্ড থেকে উৎপন্ন ।
ঘ.দ্বিমেরুযুক্ত (Bipolar) - একটি অ্যাক্সন ও একটি ডেনড্রাইট ।
ঙ. বহুমেরুযুক্ত (Multipolar) - একাধিক ডেনড্রাইট ও একটি অ্যাক্সন।
কাজের প্রকৃতি অনুসারে নিউরন তিন প্রকার-
ক.সংবেদী ( Sensory) : দেহের বিভিন্ন প্রান্তের গ্রাহক থেকে স্নায়ু উদ্দীপনা সংবেদী নিউরনের মাধ্যমেই কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে পৌঁছায়।
খ.চেষ্টীয় (Motor) : এসব নিউরন স্নায়ু উদ্দীপনা কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র থেকে বিভিন্ন অঙ্গে নিয়ে আসে ।
গ.মিশ্র বা সমন্বয়ক (Adjustor) : এসব নিউরন সংবেদী ও চেষ্টীয় নিউরনের মধ্যে সংযোগ সাধন করে।
২. নিউরোগ্লিয়া (Neuroglea):
নিউরন যে যোজক টিস্যুর ভিতরে সুরক্ষিত থাকে তাকে নিউরোগ্লিয়া বলে। চার প্রকার নিউরোগ্লিয়া হলো- (i) অ্যাস্ট্রোসাইটস,
(i) অলিগোডেনড্রোসাইটস,
(ii) মাইক্রোগ্লিয়া এবং
(iv) এপেনডাইমা ।
৩. নিউরোট্রান্সমিটারঃ যে রাসায়নিক পদার্থ সিন্যাপসের মধ্য দিয়ে এক নিউরন হতে অন্য নিউরনে বা পেশিতে বা গ্রন্থিতে স্নায়ু উদ্দীপনা পরিবহন করে তাকে নিউরোট্রান্সমিটার বলে। এরা প্রিসিন্যাপটিক নিউরনের ভেসিকলে জমা থাকে ও প্রয়োজন অনুসারে সিন্যাপটিক ক্লেফটে মুক্ত হয় । অ্যাসিটাইল কোলিন সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত নিউরোট্রান্সমিটার। এদের প্রকারভেদ নিম্নরূপ ।
ক.কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের নিউরোট্রান্সমিটার : ডোপামিন, GABA, গ্লাইসিন, গ্লুটাইমেট প্রভৃতি
খ.প্রান্তীয় স্নায়ুতন্ত্রের নিউরোট্রান্সমিটার : অ্যাসিটাইল কোলিন, অ্যাড্রেনালিন, নর এড্রেনালিন, হিস্টামিন প্রভৃতি।
৪.সিন্যাপস (Synapse):
স্নায়ুতন্ত্র অসংখ্য নিউরনে গঠিত হলেও নিউরনগুলোর মধ্যে কোনো প্রত্যক্ষ প্রোটোপ্লাজমীয় সংযোগ থাকে না। সাধারণত একটি নিউরনের অ্যাক্সন-প্রান্ত অন্য নিউরনের ডেনড্রাইট-প্রান্তের খুব কাছে অবস্থান করে কিন্তু কেউ কাউকে স্পর্শ করে না। এভাবে, দুটি স্নায়ুর মধ্যে সূক্ষ্ম ফাঁকযুক্ত সংযোগস্থল যেখানে একটি নিউরনের অ্যাক্সনের প্রান্ত শেষ হয় এবং অন্য একটি নিউরন শুরু হয়, তাকে সিন্যাপস বলে । স্নায়ু উদ্দীপনা সিন্যাপস এর মাধ্যমে কেবল একদিকে (এক নিউরনের অ্যাক্সন থেকে অপর নিউরনের ডেনড্রাইট বা কোষদেহে) পরিবাহিত হয়।
সিন্যাপস এর গঠন : দুটি নিউরনের অংশ মিলিত হয়ে সিন্যাপস গঠন করে। যে নিউরনের অ্যাক্সন সিন্যাাপস গঠনে অংশ নেয় তাকে প্রিসিন্যাপটিক নিউরন বলে। সিন্যাপস গঠনকারী অন্য নিউরনকে
পোস্টসিন্যাপটিক নিউরন বলা হয়। প্রিসিন্যাপটিক নিউরনের প্রিসিন্যাপটিক ঝিল্লি এবং পোস্টসিন্যাপটিক নিউরনেরসিন্যাপস গঠনকারী অন্য নিউরনকে ← পোস্টসিন্যাপটিক নিউরন বলা হয়। সিন্যাপস এর গঠন এবং পোস্টসিন্যাপটিক নিউরনের পোস্টসিন্যাপটিক ঝিল্লি সম্মিলিতভাবে সিন্যাপস গঠন করে। এ দুটি ঝিল্লির মাঝে প্রায় 20nm (ন্যানোমিটার) ফাঁক থাকে । এই ফাঁককে সিন্যাপটিক ক্লেফট ((synaptic cleft)) বলে। প্রিসিন্যাপটিক ঝিল্লি প্রকৃতপক্ষে প্রিসিন্যাপটিক নিউরনের অ্যাক্সনের স্ফীত প্রান্তের অংশ । অ্যাক্সনের স্ফীত প্রান্তকে সিন্যাপটিক নব (synaptic nob) বলে । এই নবের ভেতরে অসংখ্য মাইটোকন্ড্রিয়া, মাইক্রোফিলামেন্ট এবং নিউরোট্রান্সমিটারযুক্ত ভেসিকল থাকে । পোস্টসিন্যাপটিক ঝিল্লি, নিউরনের কোষদেহ বা ডেনড্রাইট বা অ্যাক্সনের অংশ ।
সিন্যাপস-এর কাজ :
*নিউরন থেকে নিউরনে তথ্য স্থানান্তর করে (প্রধান কাজ)
*স্নায়ু-উদ্দীপনাকে কেবল একদিকে প্রেরণ করে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌছাতে সাহায্য করে।
*বিভিন্ন নিউরনের প্রতি সমন্বিত সাড়া দেয়।
* অতি নিচু মাত্রার উদ্দীপনাকে বাছাই করে বাদ দিয়ে দেয়।
* প্রচন্ড স্নায়ু-উদ্দীপনায় নিউরোট্রান্সমিটার পদার্থের ক্ষরণ কমিয়ে অতি-উদ্দীপনা প্রবাহে বাধা দেয়, ফলে কার্যকর (effector) অংশ ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পায়
ট্রকলিয়ার
আবডুনেন্স
ভেগাস
গ্লোসোফ্যরিন্জিয়াল স্নায়ু
মস্তিষ্ক (Brain):
কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের যে স্ফীত ও জটিল অংশ মানুষের করোটিকার (cranium) মধ্যে সুরক্ষিত থাকে এবং দেহের সকল কার্যাবলি নিয়ন্ত্রণ করে তাকে মস্তিষ্ক বলে । ভ্রূণীয় বিকাশের সময় নিউরাল টিউবের সামনের অংশ স্ফীত হয়ে মস্তিষ্ক গঠন করে। প্রাণিজগতের মধ্যে মানব মস্তিষ্কই সবচেয়ে জটিল। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মস্তিষ্কের আয়তন পুরুষের প্রায় ১৫০০ সিসি ও মহিলাদের প্রায় ১৩০০ সিসি এবং মানব ভ্রূণের প্রাথমিক অবস্থায় মস্তিষ্ক প্রধান তিনটি অংশ নিয়ে গঠিত থাকে। পূর্ণাঙ্গ মানুষে এটি আরও জটিল রূপ ধারণ করে এবং বিভিন্ন অংশে বিভক্ত হয়। মানব ভ্রূণের মস্তিষ্কের গঠনের ভিত্তিতে পূর্ণাঙ্গ মানুষের মস্তিষ্ককে প্রধান তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়, যথা-অথমস্তিষ্ক বা প্রোসেনসেফালন (Fore brain or Prosencephalon)
•অথমস্তিষ্ক বা প্রোসেনসেফালন (Fore brain or Prosencephalon)
•মধ্যমস্তিষ্ক বা মেসেনসেফালন (Mid brain or Mesencephalol)
•পশ্চাৎমস্তিষ্ক বা রম্বেনসেফালন (Hind brain or Rhombencephalon)
১.অগ্রমস্তিষ্ক বা প্রোসেনসেফালনঃ অমস্তিষ্ক মস্তিষ্কের প্রধান অংশ গঠন করে। এটি তিন অংশে বিভক্ত, যথা- সেরিব্রাম, থ্যালামাস ও হাইপোথ্যালামস।
ক. সেরিব্রাম (Cerebrum) : দুটি পাশাপাশি অবস্থিত, বড়, কুন্ডলি পাকানো ও খাঁজবিশিষ্ট খন্ড নিয়ে গঠিত। খন্ডদুটিকে সেরিব্রাল হেমিস্ফিয়ার (cerebral hemisphere) বলে। সেরিব্রাম মস্তিষ্কের সবচেয়ে বড় অংশ (মস্তিষ্কের ওজনের ৮০%-ই হচ্ছে সেরেব্রাম) এবং মস্তিষ্কের অন্যান্য অংশকে আবৃত করে রাখে। খন্ডদুটি ভিতরে কর্পাস ক্যালোসাম (corpus callosum) নামে চওড়া স্নায়ুগুচ্ছ দিয়ে যুক্ত। সেরিব্রামের প্রাচীর দুটি স্তর নিয়ে গঠিন। বহিঃস্তর ৩ সে.মি. পুরু ও গ্রে ম্যাটার (grey matter)-এ গঠিত। নাম সেরিব্রাল কর্টেক্স (cerebral cortex)। এর নিচের স্তরটি অর্থাৎ, সেরিব্রামের অন্তঃস্তর হোয়াইট ম্যাটার (white matter)-এ গঠিত এবং সেরিব্রাল মেডুলা (cerebral medulla) নামে পরিচিত (উল্লেখ্য যে সুষুমাকান্ডের হোয়াইট ম্যাটার থাকে বাইরের দিকে, আর গ্রে ম্যাটার থাকে ভিতরের দিকে)।
ডান সেরিব্রাল হেমিস্ফিয়ার দেহের পাশ এবং বাম হেমিস্ফিয়ার দেহের ডান পাশ নিয়ন্ত্রণ করে। এ সেরেব্রোল কর্টেক্সের বহির্তল কুণ্ডলিত হয়ে অসংখ্য ভাঁজের সৃষ্টি করে। এসব ভঁজের উঁচু স্থানগুলোকে জাইরি (বহুবচন-gyri, একবচন-gyrus) এবং নিচু স্থানগুলোকে সালকি (বহুবচন-sulci, একবচন-sulcus) বলে। এতে সেরেব্রামকে ৫টি খণ্ডে বা লোবে বিভক্ত দেখা যায়। যেমন- ফ্রন্টাল লোব (frontal lobe), প্যারাইটাল লোব (parietal lobe), টেম্পোরাল লোব (temporal lobe), অক্সিপিটাল লোব (occipital lobe) এবং লিম্বিক লোব (limbic lobe)।
Grey matter = কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের ধূসর বর্ণের অংশ যা স্নায়ুকোষ, নিউরোগ্লিয়া ও সিন্যাপস নিয়ে গঠিত।
White matter = কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের টিস্যু যা মূলত মায়েলিনযুক্ত স্নায়ুতন্তু দিয়ে গঠিত। মায়েলিনযুক্ত থাকার কারণে টিস্যুটিকে সাদা চকচকে দেখায়।
কাজ : সংবেদী অঙ্গ থেকে আসা অনুভূতি গ্রহণ ও বিশ্লেষণ করে।
চিন্তা, বুদ্ধি, ইচ্ছাশক্তি, উদ্ভাবনীশক্তি প্রভৃৎ মানসিক বোধের নিয়ন্ত্রণ করে।
বিভিন্ন সহজাত প্রবৃত্তির নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করে।
বাকশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে।
সব ঐচ্ছিক পেশির কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে।
খ. থ্যালামাস (Thalamus) : প্রত্যেক সেরিব্রাল হেমিস্ফিয়ারের সেরিব্রাল মেডুলায় অবস্থিত এবং গ্রে ম্যাটারে গঠিত ডিম্বাকার অঞ্চলের নাম থ্যালামাস । দুটি থ্যালামাই (বহুবচন) একটি যোজক দিয়ে যুক্ত।
কাজ : এটি সংজ্ঞাবহ স্নায়ুর (sensory nerve) রিলে স্টেশন হিসেবে কাজ কৱে (স্নায়ু আবেগ → থ্যালামাস → সেরেব্রাম)।
চাপ, স্পর্শ, যন্ত্রণা প্রভৃতি স্থূল অনুভূতির কেন্দ্র সুতর কেন্দ্র, আবেগের কেন্দ্র ও অভ্যন্তরীণ অঙ্গের নিয়ন্ত্রক কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে।
মানুষের ব্যক্তিত্ব ও সামাজিক আচরণের প্রকাশ ঘটায়।
ঘুমন্ত মানুষকে হঠাৎ জাগিয়ে তোলা ও পরিবেশ সম্বন্ধে সতর্ক করে তােলে।
গ. হাইপোথ্যালামস (Hypothalamus): এটি থ্যালামাসের ঠিক নিচে অবস্থিত, গ্রে ম্যাটার নির্মিত এবং অন্তত এক ডজন পৃথক অঞ্চলে বিভক্ত অংশ। অংশগুলো সুনির্দিষ্ট কাজে নিযুক্ত থাকে হাইপোথ্যালামস একটি সূক্ষ্ম অংশের পিটুইটারি গ্রন্থির সংগে সংযুক্ত। এটি লিম্বিক সিস্টেম (limbic system; আচরণগত ও আবেগ সংক্রান্ত ব্যাপার নিয়ন্ত্রণ করে)-এর মূল অংশ।কাজ : স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুকেন্দ্রের কেন্দ্র হিসাবে কাজ করে।
দেহতাপ নিয়ন্ত্রণ করে।
ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ঘাম, ঘুম, রাগ, সীভন, ভালো লাগা, ঘৃণা, উদ্বেগ প্রভৃতির কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে।
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে এবং অন্তঃক্ষরা গ্রন্থির ক্ষরণ নিয়ন্ত্রণ করে।
ভ্যাসোপ্রেসিন ও অক্সিটোসিন নামে দু’রকম নিউরোহরমোন সরাসরি ক্ষরিত হয় এবং তা পশ্চাৎ পিটুইটারির মধ্যে জমা থাকে।
২.মধ্যমস্তিষ্ক (Mesencephalon):
হাইপোথ্যালামাসের নিচে এবং সেরেবেলামের সম্মুখে অবস্থিত ছোট ও সংকোচিত অংশকে মধ্যমস্তিষ্ক বা মেসেনসেফালন বলে। এটি হোয়াইট ম্যাটার দিয়ে গঠিত এবং মস্তিষ্কের কেন্দ্রীয় গহব্বকে ঘিরে রাখে । অঙ্কীয়দেশে এটি একটি স্নায়ুরজ্জু দ্বারা থ্যালামাস পনস ও সেরেবেলামকে সেরিব্রাম হেমিস্ফিয়ারের সাথে যুক্ত করে।
ক. টেকটাম (Tectum) : এটি মধ্যমস্তিষ্কের পৃষ্ঠীয় অংশ।
খ. সেরেব্রাল অ্যাকুইডাক্ট (Cerebral aqueduct) : এটি মধ্যমস্তিষ্কের ভিতরে অবস্থিত এবং মস্তিষ্কের তৃতীয় ও চিত্র চতুর্থ গহ্বরকে সংযুক্ত করে।
গ. কর্পোরা কোয়াড্রিজেমিনা (Corpora quadregemina) : এটি মধ্যমস্তিষ্কের পৃষ্ঠদেশে অবস্থিত এবং দুটি গোলাকার খণ্ড নিয়ে গঠিত।
ঘ. সেরেব্রাল পেডাল (cerebral peduncle) : এটি মধ্যমস্তিষ্কের অঙ্কীয়দেশে দুটি নলাক গঠিত।
কাজ : এটি অগ্র ও পশ্চাৎমস্তিষ্কের মধ্যে যোগসূত্র রচনা করে।
দর্শন ও শ্রবণ তথ্যের সমন্বয় ঘটায়।
৩.পশ্চাৎমস্তিষ্ক (Rhombencephalon): মস্তিষ্কের পশ্চাৎঅংশ ৩টি প্রধান অংশ দিয়ে গঠিত, যথা-
ক. সেরেবেলাম (cerebellum) : এটি পশ্চাৎমস্তিষ্কের সবচেয়ে বড় অংশ যা সেরেব্রাল হেমিস্ফিয়ারের নিচে অষ দুটি সমগোলার্ধে গঠিত। গোলার্ধ দু’টি ভার্মিস (vermis) নামে একটি ক্ষুদ্র যোজকের সাহায্যে যা বাইরের অংশ গ্রে ম্যাটার-এ এবং ভিতরের অংশ হোয়াইট ম্যাটারে-এ গঠিত। পূর্ণ বয়স্ক মানুষে সেরে প্রায় ১৫০ গ্রাম।
কাজ :ঐচ্ছিক চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ করে।
ঐচ্ছিক পেশির পেশিটান নিয়ন্ত্রণ করে।
দেহের ভার বজায় রাখে।
চলাফেরার দিক নির্ধারণ করে।
খ. পনস (pons) : এটি মেডুলা অবলংগাটার উপরের অংশের মেঝেতে অবস্থিত এবং আড়াআড়ি স্নায়ুতন্তু নির্মিত।
কাজ : সেরেবেলাম, সুষুমাকান্ড ও মস্তিষ্কের অংশের মধ্যে রিলে স্টেশন হিসেবে কাজ করে।
পেশির কর্মকান্ড সমন্বয় করে।
স্বাভাবিক শ্বাসক্রিয়ার হার নিয়ন্ত্রণ করে।
গ. মেডুলা অবলাংগাটা (Medulla obolongata) : এটি পনস-এর নিচের কিনারা ঘেঁষে প্রসারিত, অনেকটা পিরামিড আকৃতির দন্ডাকার অংশ যা লম্বায় প্রায় ৩ সেমি চওড়ায় ২ সেমি. এবং স্থূলত্বে ১.২ সেমি.।
কাজ : হৃৎস্পন্দন, শ্বসন, গলাধঃকরণ, কাশি, রক্তবাহিকার সংকোচন, লালাক্ষরণ প্রভৃতির স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে।
বমন, মল-মূত্রত্যাগ, রক্তচাপ, পৌষ্টিকনালির পেরিস্ট্যালসিস প্রভৃতি নিয়ন্ত্রণ করে।
সুষুম্নাকান্ড ও মস্তিষ্কের মধ্যে যোগসূত্র সৃষ্টি করে।
মেডুলা অবলংগাটা IX, X, XI ও XII নং করোটিক স্নায়ুর উৎসস্থল হিসে সংশ্লিষ্ট স্নায়ুর কাজ সংশ্লিষ্ট স্নায়ুর কাজ নিয়ন্ত্রণ করে।
মধ্যমস্তিষ্ক, পনস ও মেডুলা অবলংগাটাকে একত্রে ব্রেইন স্টেম (brain stem) বলে।
মস্তিষ্কের ভেন্ট্রিকল / গহ্বর / প্রকোষ্ঠ (Ventricles of Brain):
মস্তিষ্কের গঠন নিরেট নয়, এর অভ্যন্তরে তরলপূর্ণ গহ্বর থাকে। গহ্বরগুলোকে ভেন্ট্রিকল (ventricle) বলে। মানুষের মস্তিষ্কে ৪টি ভেন্ট্রিকল দেখা যায়। এগুলো ২টি পার্শ্বীয় ভেন্ট্রিকল, ৩য় ও ৪র্থ ভেন্ট্রিকল নামে পরিচিত। মস্তিষ্কের গহ্বরে বিদ্যমান তরল পদার্থের নাম সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড (cerebrospinal fluid)।
পার্শ্বীয় ভেন্ট্রিকল (Lateral Ventricles) : অগ্রমস্তিষ্কের দুটি সেরেব্রাল হেমিস্ফিয়ারের কেন্দ্রভাগে অবস্থিত ভেন্ট্রিকল দুটিকে পার্শ্বীয় ভেন্ট্রিকল বলে।
তৃতীয় ভেন্ট্রিকল (Third Ventricle) : অগ্রমস্তিষ্কের দুটি থ্যালামাসের মধ্যবর্তী গহ্বরকে ৩য় ভেন্ট্রিকল বলে। ইন্টারভেন্ট্রিকুলার ফোরামিনা-র সাহায্যে এটি পার্শ্বীয় ভেন্ট্রিকল দুটির সাথে যুক্ত থাকে।
চতুর্থ ভেন্ট্রিকল (Fourth Ventricle) : এটি পশ্চাত্মস্তিষ্কের মধ্যে অবস্থান করে। সেরেব্রাল অ্যাকুইডাক্ট-এর মাধ্যমে এটি তৃতীয় ভেন্ট্রিকলের সাথে যুক্ত থাকে।
যেসব স্নায়ু মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ থেকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি হয়ে করোটিকার বিভিন্ন ছিদ্রপথে বেরিয়ে দেহের সেগুলোকে করোটিক স্নায়ু ( Cranial Nerves ) বলে। মানুষের মস্তিষ্কে বারো জোড়া করোটিক স্নায়ু আছে। সম্মুখ অংশ থেকে এদের রোমান সংখ্যা (I-XII) দিয়ে সূচিত করা হয়। জোড়া স্নায়ুর প্রতিটি প্রতিপাশের অনুরূপ অঙ্গে বিস্তার লাভ করে।
কাজের প্রকৃতিভেদে করোটিক স্নায়ুকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
ক. সংবেদী স্নায়ু (Sensory nerve) : যেসব স্নায়ু দেহের প্রান্তীয় অঙ্গাদী বা সংবেদী অঙ্গ থেকে স্নায়ু উদ্দীপনা বহন করে স্নায়ুতন্ত্রে নিয়ে যায় সেসব স্নায়ুকে সংবেদী স্নায়ু বলে। এ ধরনের স্নায়ু বিভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন- অন্তর্বাহী, সংজ্ঞাবাহী, অনুভূতিবাহী ইত্যাদি।
খ. চেষ্টীয় স্নায়ু (Motor nerve) : কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র থেকে নির্দেশ বহন করে যেসব স্নায়ু নির্দিষ্ট অঙ্গে পৌছে দেয় সেগুলোকে চেষ্টীয় স্নায়ু বলে। এগুলো বহির্বাহী, আজ্ঞাবাহী ইত্যাদি নামেও পরিচিত।
গ. মিশ্র স্নায়ু (Mixed nerve) : যেসব স্নায়ুর এক বা একাধিক গুচ্ছ সংবেদী স্নায়ু এবং এক বা একাধিক গুচ্ছ চেষ্টীয় স্নায়ু নিয়ে গঠিত সেসব স্নায়ুকে মিশ্র স্নায়ু বলে। এগুলো সংবেদী ও চেষ্টীয় উভয় প্রকার স্নায়ু উদ্দীপনা পরিবহন করে।
মানুষের করোটিক স্নায়ুসমূহের নাম, উৎস, শাখা, বিস্তার, প্রকৃতি ও কাজ (Name, Source, Branch, Extension, Nature and Function of Human Cranial Nerves)
ক্রমিক সংখ্যা স্নায়ুর নাম উৎস শাখা (যদি থাকে) বিস্তার প্রকৃতি কাজ
I. অলফ্যাক্টরি — অগ্রমস্তিষ্কের অঙ্কীয়দেশ(অলফ্যাক্টরি লোব)─ নাসিকার মিউকাস ঝিল্লি সংবেদী ঘ্রাণ অনুভূতি মস্তিষ্কে পৌছানো
II. অপটিক — অগ্রমস্তিষ্কের অঙ্কীয়দেশ (অপটিক লোব) ─ চোখের রেটিনা সংবেদী দর্শন অনুভূতি মস্তিষ্কে পৌছানো
III. অকুলোমোটর — মধ্যমস্তিষ্কের অঙ্কীয়দেশ ─ অক্ষিগোলকের পেশি, উর্ধ্ব নেত্রপল্লব উত্তোলনকারী পেশি ও পিউপিল সংকোচনকারী চেষ্টীয় (motor) অক্ষি-গোলকের সঞ্চালন
IV. ট্রকলিয়ার— মধ্যমস্তিষ্কের পৃষ্ঠ-পার্শ্বদেশ ─ চোখের সুপিরিয়র অবলিক পেশি চেষ্টীয় অক্ষি-গোলকের সঞ্চালন
V. ট্রাইজেমিনাল— পনস-এর অগ্র-পার্শ্বদেশ অপথ্যালমিক— অক্ষিপল্লব, নাসিকার মিউকাস সংবেদী ম্যাক্সিলারি
ম্যাক্সিলারি —অক্ষিপল্লব, উর্ধ্ব ও নিম্নচোয়াল সংবেদী সংশ্লিষ্ট অঙ্গ থেকে সংবেদ মস্তিষ্কে প্রেরণ
ম্যান্ডিবুলার মুখবিবরের অঙ্কীয়দেশের পেশি মিশ্র (mixed) সংশ্লিষ্ট অঙ্গ সঞ্চালন এবং তাপ, চাপ ও স্পর্শ সংবেদ বহন
VI. অ্যাবডুসেন্স —পনস ও মেডুলার সংযোগস্থলের অঙ্কীয়দেশ ─ বহিঃরেক্টাস নামের চক্ষুপেশি চেষ্টীয় অক্ষিগোলকের সঞ্চালন
VII. ফ্যাসিয়াল —পনস ও মেডুলার সংযোগস্থলের পার্শ্বদেশ প্যালাটাইন মুখবিবরের ছাদ সংবেদী স্বাদ গ্রহণ
অকুলোমোটর মধ্যমস্তিষ্কের অঙ্কীয়দেশ হায়োম্যান্ডিবুলা মুখবিবর ও নিম্নচোয়াল মিশ্র চর্বন, গ্রীবা সঞ্চালন
VIII. ভেস্টিব্যুলোকক্লিয়ার বা অডিটরি —পনস ও মেডুলার সংযোগস্থলের পার্শ্বদেশ ─ অন্তঃকর্ণ সংবেদী শ্রবণ ও ভারসাম্য রক্ষা
IX. গ্লসোফ্যারিঞ্জিয়াল —মেডুলার পার্শ্বদেশ ─ জিহ্বা ও গলবিলের মিউকাস পর্দা মিশ্র স্বাদগ্রহণ, জিহ্বা ও গলবিলের সঞ্চালন
X. ভেগাস (নিউমোগ্যাস্ট্রিক)— মেডুলার পার্শ্বদেশ— ল্যারিঞ্জিয়াল স্বরযন্ত্র মিশ্র স্বরযতন্ত্রের কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণ
কার্ডিয়াক —হৃৎপিন্ড— মিশ্র —হৃৎপিন্ডের কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণ
গ্যাস্ট্রিক —পাকস্থলি —মিশ্র —পাকস্থলির কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণ
পালমোনারি —ফুসফুস— মিশ্র— ফুসফুসের কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণ
XI. স্পাইনাল অ্যাক্সেসরি— মেডুলার পার্শ্বদেশ ─ গলবিল, স্বরযন্ত্র, গ্রীবা ও কাঁধ চেষ্টীয় মাথা ও কাঁধের সঞ্চালন
XII. হাইপোগ্লোসাল —মেডুলার অঙ্কীয়দেশ ─ জিহ্বা ও গ্রীবা চেষ্টীয় জিহ্বার বিচলন
কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের পিছনের প্রলম্বিত অংশটি সুষুম্নাকাণ্ড । মেডুলা অবলংগাটার নিচের অংশ থেকে উদগত হয়ে এটি ফোরামেন ম্যাগনাম (foramen magnum) নামক করোটির পশ্চাৎভাগে অবস্থিত একটি বড় গোল ছিদ্রের মধ্য দিয়ে ক্রমশ সংকীর্ণ হয়ে মেরুদণ্ডের নিউরাল নালির মাধ্যমে পিছনে লাম্বার কশেরুকা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। সুষুমাকাণ্ড মস্তিষ্কের মতো মেনিনজেস দিয়ে আবৃত থাকে। এর বাইরের আবরণকে ড্যুরা ম্যাটার এবং ভিতরের আবরণকে পায়া ম্যাটার বলে। উভয় পর্দার মাঝখানে তৃতীয় আরেকটি পর্দাকে অ্যারাকনয়েড ম্যাটার বক্সে মস্তিষ্কের মতো সুষুমাকাণ্ডের অভ্যন্তরেও গহ্বর আছে। মস্তিষ্কের গহ্বরকে ভেন্ট্রিকল বলা হলেও সুষুমাকাণ্ডের গহ্বরকে কেন্দ্রীয় নালি (central canal) বলা হয়। এ কেন্দ্রীয় নালির নিচের প্রান্তে একটু স্ফীত অংশ থাকে যা টারমিনাল ভেন্ট্রিকল নামে পরিচিত। গহ্বরের মধ্যে সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড নামক তরল পদার্থ থাকে। কেন্দ্রীয় নালির চারদিকে নিউরনের কোষদেহ, ডেনড্রাইট এবং সিন্যাপসে গঠিত ইংরেজি ‘H’ আকৃতির বা প্রজাপতি আকৃতির গ্রে ম্যাটার (grey mater) অঞ্চল অবস্থিত । বস্তুত স্নায়ুকোষ দিয়ে গঠিত হওয়ায় এমন ধূসর বর্ণের হয়। গ্রে ম্যাটার অঞ্চল হোয়াইট ম্যাটার (white matter) অঞ্চল দিয়ে পরিবেষ্টিত থাকে। বাইরের হোয়াইট ম্যাটার স্তরে কোন কোষবস্তু নেই, শুধু স্নায়ুসূত্র (অ্যাক্সন) রয়েছে। সুষুমাকাণ্ড থেকে ৩১ জোড়া সুষুম্নাস্নায়ু (spinal nerves) উৎপন্ন হয়। পৃষ্ঠীয় মূল প্রত্যেক স্নায়ুর দুটি করে মূল থাকে, যথা- পৃষ্ঠীয় মূল (dorsal root) এবং অঙ্কীয় মূল (ventral root)। পৃষ্ঠীয় মূলে পৃষ্ঠীয় মূল গ্যাংগ্লিয়া (dorsal root ganglia) থাকে যা সংবেদী নিউরনের সংবেদী নিউরনের কোষদেহ নিয়ে গঠিত।
কাজ :
* সুষুমাকান্ড সরল স্পাইনাল প্রতিবর্ত (simple spinal reflex) সমূহের সমন্বয় কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে, যেমন- হাঁটু ঝাঁকুনি প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি।
* মূত্রথলির সংকোচনের মতো স্বয়ংক্রিয় প্রতিবর্ত সুষুমাকাণ্ডের সাহায্যে এত হয়।
* সুষুমা স্নায়ু ও মস্তিষ্কের মধ্যে যোগাযোগ মাধ্যম হচ্ছে সুষুমাকাণ্ড।
চোখ-দর্শনেন্দ্ৰিয় (Eye - Organ of Vision): চোখ এমন এক সংবেদী অঙ্গ যা আলোকের মাধ্যমে দৃষ্টি সঞ্চার করে। মানুষের চোখদুটি মাথার দুপাশে বহিঃকর্ণ ও নাসারন্ধ্রের প্রায় মধ্যবর্তী অংশে অবস্থিত। চোখ গোল অক্ষিগোলক- এ গঠিত। কয়েকটি আনুষঙ্গিক অঙ্গও চোখের সাথে জড়িত। চোখের মাত্র ট্রু অংশ বাইরে উন্মোচিত, বাকি অংশই কোটরের ভেতরে অবস্থান করে। চোখের পর্দায় অবস্থিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রন্থি থেকে ক্ষরিত রসে চোখ সিক্ত থাকে।
মানুষের চোখের বিভিন্ন অংশকে দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়, যেমন- অক্ষিগোলক (eye ball) ও আনুষঙ্গিক অঙ্গ।
অক্ষিগোলক (Eye ball):
মানুষের চোখ দেখতে গোল বলের মতো হওয়ায় অক্ষিগোলক নামে পরিচিত। প্রত্যেক গোলক তিনটি প্রধান অংশ নিয়ে গঠিত- A. অক্ষিগোলকের স্তর, B. লেন্স ও C.আই ব্রো/ভ্রু
A. অক্ষিগোলকের স্তর (Layers of Eye ball)
১. স্ক্লেরা (Sclera) বা স্ক্লেরোটিক স্তর (Sclerotic byer): এটি অক্ষিগোলকের বাইরের সাদা, অসচ্ছ ও সময় স্তর। এটি অস্বচ্ছ হলেও চোখের সামনের দিকে খুব কে মোনা ও স্বচ্ছ পর্দায় পরিণত হয়েছে। স্বচ্ছ পর্দাটির নাম (cornea)। কর্ণিয়াটি পুনরায় আরও একটি পাতলা পর্দা বা কনজাংটিভা (conjunctiva)-য় আবৃত। স্ক্লেরাচোখের আকৃতি রক্ষা করে, চোখকে সংরক্ষণ করে ও পেশি সংযুক্ত রাখে। কর্ণিয়ার মধ্য দিয়ে চোখের ভে প্রবেশ করে। কনজাংটিভা চোখকে ধূলাবালি ও জীবাণু থেকে রক্ষা করে।
২. কোরয়েড (Choroid) : এটি স্ক্লেরার নিচে অবস্থিত রক্তবাহিকাসমৃদ্ধ ও মেলানিন (melanin) রঞ্জকে রঞ্জিত স্তর। মেলানিন রঞ্জক থাকায় এটি কালো দেখায় রঞ্জক পদার্থ চোখের ভেতরে আলোর প্রতিফলনকে হ্রাস করে। রক্তবাহিকাগুলো চোখের কোষে পুষ্টি জোগায়, O2 সরবরাহ করে ও বর্জ্য অপসারণ করে।
আইরিশ ও কোরয়েডের সংযোগস্থলে অবস্থিত স্কুল বলয়াকার অংশ সিলিয়ারী বড়ি বা সিলীয় অঙ্গ। এটি সিলটি বলয় (ciliary ring), সিলীয় প্রবর্ধক (ciliary processes) ও সিলীয় পেশি (ciliary muscles) দিয়ে গঠিত। চোখের লেন্স সাসপেন্সরী লিগামেন্ট (suspensory ligament) দিয়ে সিলিয়ারী বডির সাথে যুক্ত। সিলীয় পেশিগুলো লেন্সের আকৃতি পরিবর্তন করে উপযোজন ক্রিয়ায় অংশ নেয়। সিলিয়ারী বডি অ্যাকুয়াস হিউমারও উৎপন্ন করে। লেন্সের চারদিক বেষ্টনকারী লিগামেন্টের নাম সাসপেন্সরী লিগামেন্ট। লিগামেন্টের অপর প্রান্ত সিলিয়ারী বড়ির সাথে যুক্ত থাকে। সাসপেন্সরী লিগামেন্ট দিয়ে লেপটি যথাস্থানে অবস্থান করে এবং সিলিয়ারী বডির সাথে যুক্ত থাকে। (কর্ণিয়ার পেছনে কোরয়েডের বাড়ানো অস্বচ্ছ, গোল ও মধ্য-ছিদ্রযুক্ত কালো রংয়ের পর্দাটির নাম আইরিশ) (iris)। এটি কর্ণিয়ার পেছনে ও লেন্সের সামনে অবস্থিত এবং দুধরনের অনৈচ্ছিক পেশিতে গঠিত। আইরিশ পেশির সংকোচন- প্রসারণ পিউপিলকে বড় ও ছোট করে, ফলে লেন্সে পরিমিত আলোর প্রবেশ নিশ্চিত হয়।
আইরিশের কেন্দ্রে পিউপিল (pupil) নামক একটি ছিদ্র থাকে। পিউপিলকে ঘিরে বৃত্তাকার ও অরীয় পেশি অবস্থিত। আলোকের তীব্রতা অনুযায়ী অরীয় ও বৃত্তাকার পেশির সংকোচন ও প্রসারণের সাহায্যে পিউপিলটি প্রয়োজন মতো ছোট-বড় করা যায়। অরীয় পেশি প্রসারিত হলে এবং বৃত্তাকার পেশি সংকুচিত হলে পিউপিল ছোট হয় এবং অরীয় পেশি সংকুচিত হলে ও বৃত্তাকার পেশি প্রসারিত হলে পিউপিল বড় হয়ে অক্ষিগোলকের ভেতরে আলোকের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করে। পিউপিলের মধ্য দিয়ে চোখে আলো প্রবেশ করে । মৃদু আলোতে পিউপিল বড় হয় এবং উজ্জ্বল বা তীব্র আলোতে পিউপিল ছোট হয়।
৩. রেটিনা (Retina) : এটি কোরয়েডের নিচে অবস্থিত এবং একমাত্র আলো - সংবেদী অংশ। এতে দুধরনের আলো- পবেদী কোষ আছে, যথা-রড (rod) ও কোন (cone) কোষ। রডকোষগুলো লম্বাটে ও রোডপসিন (rhodopsin) নামক প্রোটিনযুক্ত। কোনকোষগুলো কোণাকৃতি ও আয়োডপসিন ( iodopsin) নামক প্রোটিনযুক্ত। চোখে রডকোষ ও কোনকোষের সংখ্যা যথাক্রমে প্রায় বার কোটি পঞ্চাশ লক্ষ এবং সত্তর লক্ষ। কোনকোষগুলো উজ্জ্বল আলোতে দর্শনের রঙিন বস্তু দর্শনের জন্য এবং ছবির সঠিক বিশ্লেষণের জন্য উপযোগী। রডকোষগুলো অনুজ্জ্বল আলোতে (dim) ight) দর্শনের উপযোগী ।
তিন ধরনের কোনকোষ আছে বলে মনে করা হয়। প্রথম ধরনের কোনকোষ লাল রং, দ্বিতীয় ধরন সবুজ রং এবং রতীয় ধবন হলে সাদা রং দৃষ্ট হয়। রেটিনা বস্তুর প্রতিবিম্ব হট করে। রেটিনার সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অংশগুলো নিচে বর্ণিত হলো।
অন্ধবিন্দু (Blind spot) : অ্যাক্সনগুলো অক্ষিগোলকের যে বিন্দুতে মিলিত হয়ে অপটিক স্নায়ু গঠন করে, সে বিন্দুটি অন্ধবিন্দু । সেখানে কোনো রডকোষ বা কোনকোষ থাকে না, তাই আলোক সংবেদী নয় ।
ফোবিয়া সেন্ট্রালিস (Fovea centralis) : অন্ধবিন্দুর কাছাকাছি রেটিনার একটি অংশে প্রচুর কোনকোষ দেখা যায়, রডকোষ থাকে না। এ অংশ পীতবিন্দু (yellow spot) বা ফোবিয়া সেন্টালিস। এটি অতিরিক্ত আলো সংবেদী, তাই এখানে সবচেয়ে ভাল প্রতিবিম্ব সৃষ্টি হয় ।
অপটিক স্নায়ু : রেটিনা স্তরে গ্যাংগ্রিওনসমৃদ্ধ নিউরনগুলোর অ্যাক্সনসমূহ একত্রিত হয়ে অপটিক স্নায়ু গঠন করে। রেটিনায় সৃষ্ট প্রতিবিম্ব অপটিক স্নায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্কে পৌছায়।
B. লেন্স (Lens):
পিউপিলের পেছনে অবস্থিত ও সিলিয়ারী বুড়ির সাথে বসপেন্সরী লিগামেন্টযুক্ত হয়ে ঝুলে থাকা একটি স্বচ্ছ স্থিতিস্থাপক ও ডিলে চাকতির মতো অংশকে লেন্স বলে । লেন্সতত্ত্ব ( lens fibres- নিউক্লিয়াসবিহীন সরু লম্বা কোষ) লেন্সের পেছনের চেয়ে সামনের তত বেশি চাপা, নরম ও কিছুটা হলুদ। বয়স বাড়ার সাথে সাথে এটি আরো চাপা, হলদে ও দৃঢ় হয়, ফলে এর স্থিতিস্থাপকতা কমে যায় । তাপে রক্ত সরবরাহ নেই। সিলীয় পেশির সংকোচন-প্রসারণে লেন্স ও সংকুচিত প্রসারিত হয়। লেন্সের সাহায্যে আলোক রশ্মি বক্রতা প্রাপ্ত হয়ে রেটিনায় নিক্ষিপ্ত হয়। লেন্সের মাধ্যমে বস্তু থেকে আগত আলোক রশ্মি রেটিনার নির্দিষ্ট অংশে প্রতিফলিত হয়।
C. অক্ষিগোলকের গহ্বর বা প্রকোষ্ঠ (Chambers) অক্ষিগোলকে তরল পদার্থ পূর্ণ তিনটি গহ্বর বা প্রকোষ্ঠ আছে ।
অগ্র প্রকোষ্ঠ (Anterior chamber) : এটি কর্ণিয়া ও আইরিশের মধ্যবর্তী প্রকোষ্ঠ । এটি অ্যাকুয়াস হিউমার (aquous humour) নামক পানির মতো তরল পদার্থ দিয়ে পূর্ণ থাকে।
পশ্চাৎ প্রকোষ্ঠ (Posterior chamber) : এটিও অ্যাকুয়াস হিউমার দিয়ে পূর্ণ আইরিশ ও লেন্সের মধ্যবর্তি অবস্থানে থাকে।
ভিট্রিয়াস প্রকোষ্ঠ (Vitrious chamber) : এটি লেন্স ও রেটিনার মধ্যবর্তী বৃহৎ প্রকোষ্ঠ যা ভিট্রিয়াস হিউমার ভিটিয়াস হিউমার প্রকৃত পক্ষে ডিমের সাদা অংশের মতো ঘন কিন্তু স্বচ্ছ। ৯৯% পানি এবং ১% কোলাজেন (vitreous humour) নামক জেলির মতো স্বচ্ছ চটচটে পদার্থ দিয়ে পূর্ণ । হায়াল্যুরোনিক এসিড (hyaluronic acid) এ ভিট্রিয়াস হিউমার গঠিত। অ্যাকুয়াস হিউমার আলোর প্রতিসরণে সাহায্য করে, চোখের সম্মুখ অংশের আকৃতি ঠিক রাখে এবং লেন্স ও জোগায় । ভিট্রিয়াস হিউমার রেটিনার দিকে আলোর প্রতিসরণে সাহায্য করে এবং অক্ষিগোলকের আকৃতি বজায় রাখে।
চোখের আনুষঙ্গিক অংশ (Accessory Parts of Eye):
১. অক্ষিকোটর (Orbit) : এটি মস্তক ও মুখমন্ডলের অস্থি দিয়ে নািমত প্রাচীরে আবদ্ধ একটি ফাপা গর্তবিশেষ। এতে অক্ষিগোলক সুরক্ষিত থাকে।
২. অক্ষিপেশি (Eye muscles) : অক্ষিকোটরে (orbit) দুই শ্রেণির পেশি থাকে- এক্সট্রিনসিক ও ইন্ট্রিনসিক। যেসব পেশি অক্ষিগোলকের বাইরের দিকে অবস্থান করে তাদেরকে এক্সট্রিনসিক (extrinsic or extraocular) পেশি বলে। অপরদিকে যেসব পেশি অক্ষিগোলকের অভ্যন্তরে থাকে তাদের বলা হয় ইন্ট্রিনসিক (intrinsic) পেশি। আইরিশের পেশি ইত্যাদি ইন্ট্রিনসিক পেশির উদাহরণ। প্রতিটি অক্ষিগোলকের বাইরের দিকে সাতটি করে এক্সট্রিনসিক পেশি থাকে। এর মধ্যে ৪টি রেক্টাস (rectus), ২টি অবলিক (oblique) এবং ১টি লিভেটর পালপেত্রি সুপিরিওরিস (levator palpebrae superioris)। এসব পেশিতে করোটি স্নায়ু বিস্তৃত থাকে। পেশিগুলো অক্ষিগোলককে সঠিক স্থানে ধরে রাখে। তাছাড়া গোলককে বিভিন্ন দিকে ঘোরাতে এবং অক্ষিপল্লব উত্তোলনে সাহায্য করে। পেশিগুলো নিমরূপ :
ক. মিডিয়াল রেক্টাস (Medial rectus) : অক্ষিগোলককে অক্ষিকোটরের ভিতরের দিকে ঘুরতে সাহায্য করে।
খ. ল্যাটেরাল রেক্টাস (Lateral rectus) : অক্ষিগোলককে অক্ষিকোটরের বাইরের দিকে ঘুরতে সাহায্য করে।
গ. সুপিরিয়র রেক্টাস (Superior rectus) : অক্ষিগোলককে অক্ষিকোটরের উপর দিকে ঘুরতে সাহায্য করে।
ঘ. ইনফিরিয়র রেক্টাস (Inferior rectus) : অক্ষিগোলককে অক্ষিকোটরের নিচের দিকে ঘুরতে সাহায্য করে।
ঙ. সুপিরিয়র অবলিক (Superior oblique) : অক্ষিগোলককে অপটিক স্নায়ু ও কর্নিয়ার মধ্যবর্তী অক্ষ বরাবর ঘুরতে সাহায্য করে।
চ. ইনফিরিয়র অবলিক (Inferior oblique) : অক্ষিগোলককে সুপিরিয়র অবলিক পেশির বিপরীত দিকে ঘুরতে সহায়তা করে।
লিভেটর পালপেব্রি সুপিরিওরিস (Levator palpebrae superioris) : এ পেশি উর্ধ্ব অক্ষিপল্লবকে উপরে তুলতে সাহায্য করে। উপরোক্ত পেশিগুলো চোখকে অক্ষিকোটরের স্বস্থানে আটকে রাখে এবং অক্ষিগোলককে ঘুরতে সাহায্য করে।
উপরোক্ত পেশিগুলো চোখকে অক্ষিকোটরের স্বস্থানে আটকে রাখে এবং অক্ষিগোলককে ঘুরতে সাহায্য করে।
৩. অক্ষিপল্লব বা চোখের পাতা (Eyelid) : প্রত্যেক চোখের উপরে ও নিচে রোমযুক্ত পেশিবহুল পাতার মতো দুটি পর্দা থাকে। উপরেরটি উর্ধ্ব অক্ষিপল্লব ও নিচেরটি নিম্ন অক্ষিপল্লব। এছাড়া আরও একটি অক্ষিপত্র রয়েছে যা উপ-অক্ষিপল্লব বা নিকটিটেটিং পর্দা (nictitating membrane) নামে পরিচিত। এটি মানুষের একটি লুপ্তপ্রায় নিক্রিয় (vestigeal organ) অঙ্গ হিসেবে উভয় চোখের ভিতরের কোণায় অবস্থিত এবং দেখতে লালচে রঙের মাংসপিণ্ডের মতো। অক্ষিপল্লব ধূলাবালি, তীব্র আলো ও বাতাস থেকে চোখকে রক্ষা করে।
৪.অক্ষিপক্ষ (Eyelash) : চোখের পাতার লোমকে পিউপিল অক্ষিপক্ষ বলে। এগুলো চোখে ধূলাবালি প্রবেশে বাধা দেয়।
৫. আই ব্রো (Eye brow) : চোখের পাতার উপর অংশের লোমকে আই ব্রো বলে । কপাল থেকে গড়িয়ে আসা ঘামের চোখে প্রবেশ প্রতিহত করাই এর কাজ।
৬. অক্ষিগ্রন্থি (Eye glands) : চক্ষুতে বিদ্যমান রস ক্ষরণকারী কোষগুলোকে অক্ষিগ্রন্থি বলে। চক্ষুতে তিন প্রকার অক্ষিগ্রন্থি থাকে, যথা-
ল্যাক্রিমাল গ্রন্থি (Lacrimal gland) : এটি অক্ষি গোলকের অগ্রভাগের পৃষ্ঠদেশে অবস্থিত। এটি অশ্রু (tear) নামক এক প্রকার মৃদু লবণাক্ত জলীয় তরল ক্ষরণ করে যাতে ব্যাকটেরিয়ানাশক লাইসোজাইম (lysozyme) এনজাইম থাকে।
কাজ :এটি থেকে নিঃসৃত অশ্রু ধূলোবালি বিধৌত করে চক্ষুকে পরিষ্কার রাখে, কনজাংক্টিভাকে নরম ও আর্দ্র রাখে এবং কর্নিয়াকে পুষ্টি দেয়।
অশ্রুতে বিদ্যমান লাইসোজাইম ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস সুরক্ষা দেয়।
হার্ডেরিয়ান গ্রন্থি (Harderian gland) : এটি অক্ষিগোলকের পশ্চাৎভাগের অঙ্কীয়দেশে অবস্থিত। এক প্রকার পাতলা তৈলাক্ত রস ক্ষরণ করে।
কাজ : এর তৈলাক্ত ক্ষরণ অক্ষিপল্লব, কনজাংকিভা ও কর্নিয়াকে সিক্ত ও পিচ্ছিল রাখে।
মিবোমিয়ান গ্রন্থি (Meibomian gland) : এটি অক্ষিপল্লবের কিনারায় অবস্থিত এবং এক প্রকার গাঢ় তৈলাক্ত রস ক্ষরণ করে।
কাজ : এর তৈলাক্ত ক্ষরণ কনজাংক্টিভা ও কর্নিয়াকে পিচ্ছিল রাখে।
৭. কনজাংক্টিভা (Conjunctiva) : অক্ষিপল্লবের ভিতরের অংশ এবং স্ক্লেরার অগ্রাংশ (সাদা অংশ) যে স্বচ্ছ পাতলা মিউকাস স্তরে আবৃত থাকে তার নাম কনজাংটিভা। এটি চোখকে ধূলাবালি ও জীবাণু থেকে রক্ষা করে। চোখের সম্মুখতল এবং অক্ষিপরের ভিতরের তল আর্দ্র ও পিচ্ছিল রাখে।
প্রতিবিম্ব গঠন ও দর্শন প্রক্রিয়া (Formation of Image and Mechanism of Vision):
দর্শন প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল এবং পাঁচটি ধাপে সংঘটিত হয়, যথা-
*চোখে আলোর প্রবেশ।
*রেটিনায় প্রতিবিম্ব গঠন।
*প্রতিবিম্ব গঠনকারী রশ্মির বৈদ্যুতিক সিগন্যালে রূপান্তর।
*প্রতিবিম্ব সম্পর্কে স্নায়ু অনুভূতি (impulse) মস্তিষ্কে প্রেরণ।
*মস্তিষ্কের মাধ্যমে স্নায়ু অনুভূতির বিশ্লেষণ ও দর্শন।
Formation of Image
আমরা যে বস্তুকে দেখি, আলোকিত সে বস্তু থেকে আলোক রশ্মি প্রথমে কর্নিয়ার উপর পড়ে। স্বচ্ছ কর্নিয়ায় প্রতিসরিত আলোক রশ্মি পিউপিলের মাধ্যমে লেন্সে এসে পড়ে। দ্বিউত্তল লেন্স এ আলোক রশ্মিকে পুনরায় প্রয়োজনমত প্রতিসরণের মাধ্যমে রেটিনায় প্রতিফলিত করে। ফলে রেটিনার উপর বস্তুর একটি উল্টা প্রতিবিম্ব সৃষ্টি হয়। রেটিনায় সৃষ্ট প্রতিবিম্ব রেটিনার আলোক সংবেদী কোষ (রডকোষ ও কোণকোষ)-কে উদ্দীপ্ত (simulate) করে। আলোক সংবেদী কোষের এ অনুভূতি বাইপোলার কোষ, গ্যাংলিয়ন কোষ এবং অপটিক স্নায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্কে অপটিক লোবের দৃষ্টি কেন্দ্র বা ভিসুয়াল কর্টেক্স-এ পৌছায়। এ অঞ্চলে স্নায়ু অনুভূতি থেকে প্রাপ্ত উল্টা প্রতিবিম্বের তথ্য বিশ্লেষণ হয় ফলে মানুষ বস্তুটিকে সোজা দেখতে পায়।
দর্শন কৌশলের গতিপথ হচ্ছে–
আলোকরশ্মি → কর্নিয়া → অ্যাকুয়াস হিউমার → পিউপিল → লেন্স → ভিট্রিয়াস হিউমার → রেটিনা → অপটিক স্নায়ু → মস্তিষ্কের ভিসুয়্যাল কর্টেক্স।
উপযোজন (Accommodation)
দর্শনীয় বস্তু ও লেন্সের মধ্যকার দূরত্বের পরিবর্তন না করেই সিলিয়ারি পেশি ও সাসপেন্সরি লিগামেন্টের সংকোচন, এ লেন্সের বক্রতার তথা ফোকাস দূরত্বের পরিবর্তন ঘটিয়ে বিভিন্ন দূরত্বে অবস্থিত বস্তুকে সমান স্পষ্ট দেখার যে বিশেষ ধরনের পরিবর্তন ঘটে সে প্রক্রিয়াকে উপযোজন বলে। চোখ থেকে ৬ মিটার দূরত্বে অবস্থিত কোন বস্তুর প্রতিবিম্ব স্বাভাবিকভাবে রেটিনায় প্রতিফলিত হয়। এ দূরত্বের কম বেশি হলে বস্তুর প্রতিবিম্ব রেটিনায় মাসের জন্য উপযোজন প্রয়োজন । মানুষসহ বিভিন্ন স্তন্যপায়ী প্রাণীতে উপযোজন একটি বৈশিষ্ট্য। এ সময় সিলিয়ারি বডিতে বিদ্যমান বৃত্তাকার পেশির সংকোচনের ফলে সাসপেনসরি লিগামেন্টের প্রসারণ ঘটে। ফলে লেন্সের বক্রতা বাড়ে ও খাটো হয়। লেন্সের ফোকাস দূরত্ব কমে গিয়ে কাছের বস্তুটি দৃষ্টিগোচর হয়। দূরের বস্তু দেখার সময় এর উল্টোটি ঘটে। অর্থাৎ, সিলিয়ারি বডির বৃত্তাকার পেশির প্রসারণ, সাসপেনসরি লিগামেন্টের সংকোচনে লেন্সের বক্রতা কমে, লেন্স সরু ও লম্বা হয় এবং ফোকাস দূরত্ব বেড়ে যায় এবং দূরের বস্তু থেকে আলোকরশ্মি রেটিনায় পতিত হয়ে প্রতিবিম্ব গঠন করে। তখন বস্তুটি দৃশ্যমান হয়। যে দৃষ্টিতে কাছের বস্তু স্পষ্ট দেখা যায় না তাকে হাইপারমেট্রোপিয়া (hypermetropia) বলে। উত্তল লেন্সের চশমা ব্যবহারে সমস্যার সমাধান হয়। যদি দূরের বস্তু দেখতে সমস্যা হয় তবে তাকে মায়োপিয়া (myopia) বলে। অবতল লেন্সের চশমা কাছের বস্তু দর্শন কৌশল দূরের বস্তু দর্শন কৌশল ব্যবহারে এ সমস্যা দূরীভূত হয়।
দ্বিনেত্র দৃষ্টি (Binocular vision) বা স্টেরিওস্কোপিক দৃষ্টি (Stereoscopic vision)
মানুষের দৃষ্টিকে দ্বিনেত্র দৃষ্টি বলে। কারণ আমরা কোনো দৃশ্যযোগ্য বস্তু একই সাথে দু’চোখের সাহায্যে এককভাবে দেখতে পাই। কোনো বস্তু থেকে প্রতিফলিত আলোকরশ্মি রেটিনায় পড়লে যে স্নায়ু উদ্দীপনার সৃষ্টি করে তা স্বতঃস্ফূর্তভাবে মস্তিষ্কের দৃষ্টিকেন্দ্রে (visual cortex) একটি মাত্র প্রতিবিম্বে একত্রীভূত হয়, ফলে আমরা দুচোখে একটি বস্তুকে এককভাবে দেখি। মানুষের চোখদুটি মাথার সামনে ৬.৩ সেন্টিমিটার দূরত্বে অবস্থিত। ফলে কোনো বস্তু দেখার সময় প্রত্যেক চোখ বস্তটির একটি করে প্রতিবিম্ব সৃষ্টি করে। প্রতিবিম্ব দুটির একটি থেকে অন্যটি কিছুটা আলাদা। উভয় উদ্দীপনা মস্তিষ্কে প্রেরিত হয়। মস্তিষ্ক দুটি উদ্দীপনাকে সমন্বয় সাধন করে। ফলে বস্তুর একটি ত্রিমাত্রিক (three dimensional) চিত্র দেখা যায়।
দ্বিনেত্র দৃষ্টির শর্ত (Conditions of Binocular vision) :
• নির্দিষ্ট বস্তুতে নিবদ্ধ করার জন্য এভাবে দেখে অক্ষিপেশিকে সঠিকভাবে সংকুচিত হতে হবে।
• দুচোখের রেটিনায় সদৃশ বিন্দুর উপস্থিতি থাকতে হবে।
• দুচোখের রেটিনায় প্রায় একইরকম প্রতিবিম্বের সৃষ্টি হতে হবে।
• দুটি বীক্ষণক্ষেত্রকে এক জায়গায় পরস্পর মিলে যেতে হবে।
কান (Ear): এমন এক বিশেষ ইন্দ্রিয় যা একাধারে শ্রবণ ও দেহের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ-এ অংশগ্রহণ করে। মানুষের মাথার দুপাশে ও চোখের পিছনে করোটির শ্রুতিকোটরে দুটি কান অবস্থান করে। মানুষের প্রতিটি কান ৩টি অংশে বিভক্ত, যথা- বহিঃকর্ণ (External ear), মধ্যকর্ণ (Middle ear) ও অন্তঃকর্ণ (Internal ear)।
ক. বহিঃকর্ণ (External ear)
বাইরের দিকে থেকে এটি কানের প্রথম ভাগ এবং নিম্নোক্ত ৩টি অংশ নিয়ে গঠিত।
১. পিনা (Pinna) বা অরিকল (Auricle) বা কর্ণছত্র : এটি মাথার দুপাশে অবস্থিত ও তরুণাস্থি নির্মিত কানের বাইরের প্রসারিত ও লোমশ অংশ। এর অভ্যন্তরে পেশিতন্তু থাকলেও মানুষ কান নাড়াতে পারে না। কোনো শব্দ ভালভাবে শোনার জন্য যে দিক থেকে শব্দ আসে সেদিকে মাথাসহ কানের ছিদ্রকে ঘোরাতে হয়। শব্দতরঙ্গ সংগ্রহ ও কেন্দ্রীভূত করে বহিঃঅডিটরি মিটাস বা কর্ণকুহরে প্রেরণ করা পিনার কাজ।
২. বহিঃঅডিটরি মিটাস (External auditory meatus) বা কর্ণকূহর : পিনার কেন্দ্রে কানের বহিঃছিদ্র থেকে যে সরু নালিপথ কানের টিমপেনিক পর্দা পর্যন্ত বিস্তৃত তার নাম বহিঃঅডিটরি মিটাস। এর বাইরের এক-তৃতীয়াংশ তরুণাস্থি দিয়ে এবং ভিতরের দুই-তৃতীয়াংশ অস্থিতে (tempral bone) গঠিত। এটি মোমগ্রন্থি ও সূক্ষ্ম রোমযুক্ত ত্বকে আবৃত। এর মাধ্যমে শব্দতরঙ্গ লম্বভাবে টিমপেনিক পর্দায় পৌছে । এতে অবস্থিত মোম ও লোম বাধা দেয় এবং জীবাণু নাশ করে। এটি টিমপেনিক পর্দার অনুকূল উষ্ণতা ও আর্দ্রতা বজায় রাখে।
৩. টিমপেনিক পর্দা (Tympanic membrane) বা কর্ণপটহ : বহিঃঅডিটরি মিটাসের শেষ প্রান্তে এবং মধ্যকর্ণের মুখে আড়াআড়িভাবে অবস্থিত ডিম্বাকার, স্থিতিস্থাপক পর্দাকে টিমপেনিক পর্দা বলে। এর বাইরের দিক অবতল, ভিতরের দিক উত্তল। এর সাথে মধ্যকর্ণের ম্যালিয়াস অস্থি যুক্ত থাকে। বহিঃকর্ণকে মধ্যকর্ণ থেকে পৃথক করে রাখা, শব্দতরণ কেঁপে উঠা এবং শব্দতরঙ্গকে সমতলে মধ্যকর্ণে পরিবহন করা টিমপেনিক পর্দার কাজ।
খ. মধ্যকর্ণ (Middle ear)
মধ্যকর্ণ একটি অসম আকৃতির বায়ুপূর্ণ প্রকোষ্ঠ বিশেষ এবং করোটির টিমপেনিক বুলা অবস্থিত। এতে নিচে বর্ণিত অংশগুলো পাওয়া যায়।
১. ইউস্টেশিয়ান নালি (Eustachian canal) : মধ্যকর্ণের তলদেশ থেকে সৃষ্টি হয়ে গলবিল পর্যন্ত বিস্তৃত এটি একটি সরু নালি বিশেষ। টিমপেনিক পর্দার উভয় পাশের বায়ুর চাপ সমান রাখা এর কাজ। ফলে কর্ণপটহ ফেটে যাওয়া থেকে রক্ষা পায়।
২. কর্ণাস্থি (Ear ossicles) : এগুলো মধ্যকর্ণের গহ্বরে অবমি সুনির্দিষ্টভাবে সাজানো ৩টি ছোট অস্থি । অস্থি তিনটি হচ্ছে-
ম্যালিয়াস (Malleus) : হাতুড়ির মতো দেখতে এ অস্থি একদিকে টিমপেনিক পর্দার সাথে অন্যদিকে পরবর্তী অস্থি ইনকাস-এর সাথে যুক্ত।
ইনক্সাস (Incus) : এ অস্থিটি দেখতে নেহাই (anvil)-এর মতো এবং ম্যালিয়াস ও স্টেপিসকে যুক্ত করে।
স্টেপিস (Stapes) : এ অস্থিটি দেখতে ঘোড়ার জিনের পাদানির মতো (ত্রিকোণাকার)। অস্থিটি একদিকে ইনকাসের সাথে অন্যদিকে, ফেনেস্ট্রা ওভালিস নামে ছিদ্রের গায়ে বসানো থাকে। এটি মানবদেহের ক্ষুদ্রতম অস্থি।
কাজ : অস্থিগুলো বহিঃকর্ণের টিমপেনিক পর্দা থেকে শব্দতরঙ্গ অন্তঃকর্ণের পেরিলিম্ফে বহন করে।
৩. ছিদ্রপথ (Loophole) : মধ্যকর্ণের প্রাচীর পেরিওটিক অস্থিতে গঠিত, তবে সেখানে দুটি ছোট ছিদ্রপথ থাকে। উপর দিকে ডিম্বাকার ছিদ্রকে ফেনেস্ট্রা ওভালিস (fenestra ovalis) এবং নিচের দিকের গোল ছিদ্রকে ফেনেস্ট্রা রোটান্ডা (fenestra rotunda) বলে। ফেনেস্ট্রা ওভালিসের মাধ্যমে শব্দ মধ্যকর্ণ থেকে অন্তঃকর্ণে প্রবেশ করে। শব্দতরঙ্গ ককলিয়ায় প্রবেশের পর অবশেষে ফেনেস্ট্রা রোটান্ডার মাধ্যমে বাইরে চলে আসে।
গ. অন্তঃকর্ণ (Inner ear)
প্রত্যেক অন্তঃকর্ণ করোটির শ্রুতিকোটর বা অডিটরি ক্যাপসুল (auditory capsule)-এর পেরিওটিক অস্থির (periotic bone) অভ্যন্তরে অবস্থান করে। অন্তঃকর্ণের প্রধান অংশ হলো মেমব্রেনাস ল্যাবিরিন্থ (membranous labyrinth) নামক একটি জটিল গঠন। এর অভ্যন্তরে এন্ডোলিম্ফ (endolymph) নামক তরল পদার্থ থাকে। অস্থিময় ল্যাবিরিন্থ (bony labymph) দ্বারা মেমব্রেনাস ল্যাবিরিন্থ পরিবেষ্টিত থাকে। দুই ল্যাবিরিন্থের মধ্যবর্তী স্থান পেরিলিম্ফ (perilymph) তরলে পূর্ণ থাকে। মেমব্রেনাস ল্যাবিরিন্থ ভারসাম্য ও শ্রবণের অঙ্গ নিয়ে গঠিত।
ভারসাম্য অঙ্গ (Organ of balance) :
মানুষের ভারসাম্যের অঙ্গকে ভেস্টিবিউলার অ্যাপারেটাস (vestibular aparatus) বলে। এটি ইউট্রিকুলাস (utriculus) ও স্যাকুলাস (sacculus) নামক দুটি ছোট গহ্বর এবং তিনটি অর্ধবৃত্তাকার নালি (semicircular canal) সমন্বয়ে গঠিত। ইউট্রিকুলাস ও স্যাকুলাস এন্ডোলিম্ফ তরলে পূর্ণ এবং গহ্বরের ভিতরে ম্যাকুলা (macula) নামক অঙ্গ বিদ্যমান। এগুলো ইউট্রিকুলাসের মেঝেতে আনুভূমিকভাবে এবং স্যাকুলাস প্রাচীরের গাত্রে উলম্বভাবে অবস্থান করে। ম্যাকুলায় সংবেদী রোমকোষ থাকে এবং এসব কোষের রোমাঞ্চলে অটোলিথ (otolith; ক্যালসিয়াম কার্বনেট কণিকা, CaCO3) সমৃদ্ধ অটোলিথিক মেমবেনে দৃঢ়ভাবে গেথে থাকে।
অর্ধবৃত্তাকার নালিগুলো ইউট্রিকুলাস থেকে বিকশিত হয় আবার ইউট্রিকুলাসেই উন্মুক্ত হয়। দুটি নালি উল্লম্বভাবে একটি অবস্থান করে। নালিগুলো পরস্পর সমকোণে অবস্থান করে এবং এক একটি নালি ঘূর্ণণের এক একটি অক্ষ নির্দেশ করে। নালিগুলো এন্ডোলিম্ফ পূর্ণ এবং প্রতিটির একটি প্রান্ত স্ফীত হয়ে অ্যাম্পুলা-য় পরিণত হয়েছে। অ্যাম্পুলায় সংবেদী রোমকোষ বিদ্যমান । রোমকোষগুলো ক্যুপুলা (cupula) নামক গভীরভাবে প্রোথিত এবং এর রোমগুলো এন্ডোলিম্ফে প্রক্ষিপ্ত অবস্থায় থাকে।
শ্রবণ অঙ্গ (Organ of hearing) :
মানুষের শ্রবণের সাথে সংশ্লিষ্ট অঙ্গকে ককলিয়া (cochlea) বলে। স্যাকুলাসের অংকীয়দেশ থেকে বের হওয়া এ অঙ্গটি শামুকের খোলকের মতো প্যাঁচানো। ককলিয়া দুটি পর্দা দিয়ে তিনটি সমান্তরাল অণুদৈর্ঘ্য প্রকোষ্ঠে বিভক্ত। উপরে পেরিলিম্ফে পূর্ণ স্ক্যালা ভেস্টিবুলি (scala vestibuli), মাঝে এন্ডোলিম্ফতে পূর্ণ স্ক্যালা মিডিয়া (scala media) এবং নিচে পেরিলিফে পূর্ণ স্ক্যালা টিমপেনি (scala tympani)। স্ক্যালা মিডিয়া উপরে রেসনার-এর ঝিল্লি (reissner’s membrane) ও নিচে বেসিলার ঝিল্লি (basilar membrane)-তে আবদ্ধ। বেসিলার ঝিল্লির উপরের কিছু এপিথেলিয়াল কোষ রূপান্তরিত হয়ে সংবেদী অর্গ্যান অব কর্টি (organ of corti) গঠন করেছে একেবারে শীর্ষে ককলিয়ার ঊর্ধ্ব ও নিম্ন প্রকোষ্ঠ একটি সরু নলাকার অংশের সাহায্যে পরস্পর যুক্ত। এর নাম হেলিকোট্রিমা (helicotrema)।
কাজ : ককলিয়া শ্রবণ উদ্দীপনা গ্রহণ এবং তা স্নায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্কে প্রেরণ করে।
শ্রবণ ও ভারসাম্য রক্ষায় কানের ভূমিকা (Role of Ear in maintaining Hearing and Balance):
মানুষের কান একই সাথে দুটি ভিন্নধর্মী কাজ সম্পাদন করে থাকে। এদের একটি শ্রবণ ও অন্যটি ভারসাম্য রক্ষা। এ দুটি কাজের একটির সাথে অন্যটির কোন সম্পর্ক নেই।
শ্রবণ কৌশল (Mechanism of Hearing):
পিনায় সংগৃহীত শব্দতরঙ্গ বহিঃঅডিটরি মিটাসে প্রবেশ করে টিমপেনিক পর্দাকে আঘাত করলে তা কেঁপে উঠে। কাঁপনে, মধ্যকর্ণে অবস্থিত ম্যালিয়াস, ইনকাস ও স্টেপিস অস্থি তিনটি এমনভাবে আন্দোলিত হয় যার ফলে প্রথমে ফেনেস্ট্রা ওভালিসের পর্দা ও পরে অন্তঃকর্ণের ককলিয়ার পেরিলিম্ফে কাঁপন সৃষ্টি হয় । পেরিলিফে কাঁপন হলে ককলিয়ার অর্গান অব কর্টি-র সংবেদী রোম কোষগুলো উদ্দীপ্ত হয়ে স্নায়ু আবেগের সৃষ্টি করে। এ আবেগ অডিটরি স্নায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্কের শ্রবণকেন্দ্রে বাহিত হলে মানুষ শুনতে পায়। এরপর বাকি শব্দ তরঙ্গ ফেনেস্ট্রা রোটান্ডা পর্দার মাধ্যমে মধ্যকর্ণে চলে আসে এবং প্রশমিত হয়ে যায়। মাত্রা অনুযায়ী শব্দ উচ্চ, মধ্যম ও নিম্নমাত্রার হয়ে থাকে। এসব মাত্রা গ্রহণের জন্য ককলিয়ার স্ক্যালা মিডিয়ায় (বেসিলার ও রেসনার-এর ঝিল্লিতে) বিশেষ স্থান রয়েছে। স্থানগুলো হচ্ছে- উচ্চ মাত্রা গ্রহণে ফেনেস্ট্রা রোটান্ডা সংলগ্ন অংশ; মধ্যম মাত্রা গ্রহণে মাঝামাঝি অংশ এবং নিম্ন মাত্রা গ্রহণে শীর্ষের কাছাকাছি অংশ।
শ্রবণ প্রক্রিয়ার গতিপথ (Direction of Hearing Process):
শব্দ তরঙ্গ → পিনায় বাধা → কর্ণকুহরে প্রবেশ → টিম্পেনিক পর্দায় কাঁপন → মধ্যকর্ণ (স্টেপিস → ইনকাস → ম্যালিয়াস) → ফেনেস্ট্রা ওভালিস → ককলিয়া → পেরিলিম্ফ → এন্ডোলিম্ফ → অর্গান অব কর্টি → সংবেদী কোষে উত্তেজনা → স্নায়ু স্পন্দন মস্তিষ্কে প্রেরণ → শ্রবণ
ভারসাম্য রক্ষা কৌশল (Mechanism of maintaining Balance):
অন্তঃকর্ণের অর্ধবৃত্তাকার নালির মূলে অবস্থিত অ্যাম্পুলা এন্ডোলিম্ফে পরিপূর্ণ ও সংবেদী রোমকোষ সম্পন্ন। এ রোমগুলোর সাথে ক্যুপুলা নামক জেলীর মতো বস্তু সংযুক্ত থাকে। মানুষ মাথা ঘোরালে বা কোনো দিকে দেহ বাঁকালে, সেদিকে অ্যাম্পুলার এন্ডোলিম্ফ প্রবাহিত হয়ে ক্যুপুলার অবস্থান পরিবর্তিত হয়। এ অনুভূতি সংবেদী কোষগুলো গ্রহণ করে মস্তিষ্কে পাঠায়। এন্ডোলিম্ফে পূর্ণ ইউট্রিকুলাস ও স্যাকুলাসে স্যাকুলা নামক এক অঙ্গ থাকে যা CaCO3-সমৃদ্ধ অটোলিথিক মেমব্রেন (otolithic membrane)-এ আবদ্ধ সংবেদী রোমকোষ বহন করে। মানুষের মাথা কোনো এক দিকে হেলে গেলে অটোলিথিক মেমব্রেন রোমকোষের উপর চাপ সৃষ্টি করে। ফলে রোমকোষ উদ্দীপিত হয় এবং স্নায়ুর মাধ্যমে এ অনুভূতি মস্তিষ্কে পাঠায় ও মাথাকে সঠিক অবস্থানে রাখতে সাহায্য করে। ইউট্রিকুলাস ও স্যাকুলাস মাধ্যাকর্ষণ শক্তির (gravity) অনুভূতি শনাক্ত করে। অন্যদিকে অ্যাম্পুলা ঘূর্ণনের অনুভূতি সংগ্রাহক (rotatory receptor) হিসেবে কাজ করে । এ দুই অনুভূতি স্নায়ুর মাধ্যমে অনবরত মস্তিষ্কে পৌছায়। অতঃপর মস্তিষ্ক তা বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে যার ফলে মানুষ নিজেকে সোজা রাখতে অর্থাৎ, ভারসাম্য রক্ষা করতে সক্ষম হয়।
মানবদেহে যাবতীয় কাজে রাসায়নিক সমন্বয়কারী (Chemical coordination) হিসেবে হরমোন (hormone) নামক এক জৈব রাসায়নিক পদার্থ ভূমিকা পালন করে। হরমোন উৎপন্ন হয় প্রধানত এক বিশেষ গ্রন্থিতন্ত্র থেকে। ক্ষরণ গুণসম্পন্ন একটি মাত্র কোষ বা কোষগুচ্ছ নিয়ে গঠিত হয় গ্রন্থি (gland)। মানবদেহের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত নানা ধরনের অসংখ্য গ্রন্থি থেকে রস নিঃসৃত হয়ে যাবতীয় শারীরবৃত্তীয় কাজ পরিচালনা করে।
গঠন ও কার্যগতভাবে বিশেষায়িত যে কোষ বা কোষগুচ্ছ দেহের বিভিন্ন জৈবনিক প্রক্রিয়ায় প্রয়োজনীয় রাসায়নিক পদার্থ ক্ষরণ করে, তাকে গ্রন্থি বা গ্ল্যান্ড বলে। গ্রন্থি এক ধরনের রূপান্তরিত আবরণী টিস্যু। ক্ষরণ পদ্ধতি ও ক্ষরণ নির্গমন নালির উপস্থিতি বা অনুপস্থিতির ভিত্তিতে গ্রন্থি দুধরনের-
* বহিঃক্ষরা বা সনাল গ্রন্থি (Exocrine Glands):
যে সব গ্রন্থি নিজের ক্ষরিত রাসায়নিক পদার্থ নালিকার মাধ্যমে উৎপত্তিস্থলের অদূরেই বহন করে, সেগুলোকে বহিঃক্ষরা গ্রন্থি বলে। বহিঃক্ষরা গ্রন্থির ক্ষরণকে রস বা জুস (juice) বলে। যেমন- লালাগ্রন্থি, যকৃত, অগ্ন্যাশয় ইত্যাদি গ্রন্থি।
* অন্তঃক্ষরা বা অনাল গ্রন্থি (Endocrine Glands) :
যে সব গ্রন্থি নালিবিহীন, তাই ক্ষরণ সরাসরি রক্ত বা লসিকার মাধ্যমে বাহিত হয়ে দূরবর্তী সুনির্দিষ্ট অঙ্গে ক্রিয়াশীল হয়, সে সব গ্রন্থিকে অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি বা অনাল গ্রন্থি (dustless gland) বলে। উদাহরণ- পিটুইটারি, থাইরয়েড, অ্যাড্রেনাল ইত্যাদি গ্রন্থি। অন্তঃক্ষরা গ্রন্থির ক্ষরণকে হরমোন বলে।
অন্তঃক্ষরা ও বহিঃক্ষরা গ্রন্থির মধ্যে পার্থক্য
অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি | বহিঃক্ষরা গ্রন্থি |
---|---|
মানবদেহে নালিবিহীন গ্রন্থিসমূহকে অন্তঃক্ষরা বলে। | মানবদেহে নালিযুক্ত গ্রন্থিসমূহকে বহিঃক্ষরা গ্রন্থি বলে। |
নিসঃরণ: এসব গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত পদার্থের নাম হরমোন। | এসব গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত পদার্থের নাম রস, জুস, এনজাইম । |
পরিবহন: রক্তে পরিবাহিত হয়। | নালির মাধ্যমে পরিবাহিত হয়। |
ক্রিয়াস্থল : হরমোন দূরবর্তী টার্গেট স্থলে কাজ করে। | এটি নিকটবর্তী বা দূরবর্তী উভয় টার্গেট স্থলে কাজ করে। |
উদাহরণ: পিটুইটারি গ্রন্থি, থাইরয়েড গ্রন্থি, অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি ইত্যাদি। | যকৃত, অগ্ন্যাশয়, লালাগ্রন্থি ইত্যাদি |
অন্তঃক্ষরা বা অনাল গ্রন্থি (Endocrine Glands)
অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি হরমোন নামক জৈব রাসায়নিক দ্বার্থ উৎপন্ন করে। এটি নালিবিহীন গ্রন্থি হওয়ায় হরমোন সরাসরি রক্তপ্রবাহে ক্ষরিত হয়। এসব গ্রন্থি রক্তবাহিকা-সমৃদ্ধ জালিকায় পরিবৃত থাকে। কিছু গ্রন্থি আছে যা একাধারে অন্তঃক্ষরা ও বহিঃক্ষরা গ্রন্থি হিসেবে কাজ করে। অগ্ন্যাশয় এমনি একটি গ্রন্থি। এ গ্রন্থির কিছু বিশেষিত কোষ থেকে ইনসুলিন ও গ্লুকাগন হরমোন উৎপন্ন ও রক্তে ক্ষরিত হয়। অন্যদিকে, এ গ্রন্থি থেকেই প্যানক্রিয়াটিক জুস (অগ্ন্যাশয়িক রস) উৎপন্ন হয়ে অগ্ন্যাশয়িক নালিতে বাহিত হয়ে অন্ত্রে পৌছায়।
নামকরণ : অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিতন্ত্র সম্পর্কিত বিজ্ঞানের সূত্রপাত বেশ আগে থেকেই। এ বিদ্যার সূত্রপাত চীনদেশে। সেখানে খৃষ্টপূর্ব ২০০ সালে অভিনব উপায়ে মানুষের মূত্র থেকে যৌন ও পিটুইটারি হরমোন সংগ্রহ করে চিকিৎসার কাজে ব্যবহৃত হতো। তবে সুনির্দিষ্টভাবে হরমোন (সিক্রেটিন) শনাক্ত করেন ১৯০২ সালে দুই ব্রিটিশ শারীরতত্ত্ববিদ william Bayliss এবং Emest Starling। তাঁরা ১৯০৫ সালে এ রাসায়নিককে হরমোন নামে অভিহিত করেন। গ্রিক শব্দ hormao (to excite = উদ্দীপ্ত/ উত্তেজিত করা) থেকে হরমোন শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। হরমোন দেহের রাসায়নিক দূত (chemical messenger) হিসেবে সুপরিচিত।
হরমোনের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে-
• হরমোন এক ধরনের ক্ষুদ্র জৈব অণু।
• হরমোন রক্তে বাহিত হয়।
• উৎপত্তিস্থল থেকে (নির্দিষ্ট কোষ বা কোষগুচ্ছ বা গ্রন্থি থেকে) সংবহনতন্ত্রের মাধ্যমে দেহের দূরবর্তীস্থানে পরিবাহিত হয়ে নির্দিষ্ট অংশে (target) কাজ করে।
• হরমোন এক ধরনের দ্রবণীয় জৈব অনুঘটকের কাজ করে কিন্তু কাজ শেষে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
হরমোন স্বল্প মাত্রায় বা ঘনত্বে কার্যকর হয় এবং ক্রিয়ার স্থায়িত্বকাল অনেকদিন বজায় থাকে।
• হরমোন সাধারণত ভবিষ্যতের জন্য জমা থাকে না।
• অধিকাংশ হরমোনের ক্রিয়া ধীরে সংঘটিত হয়।
• একটি অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি থেকে একাধিক হরমোন ক্ষরিত হতে পারে কিন্তু এগুলোর কাজ বা ক্ষরণ পরস্পর নির্ভরশীল নয়।
• স্নায়ুতন্ত্রের সাথে সম্পর্ক রেখে হরমোন বিভিন্ন দৈহিক ও শারীরবৃত্তিক কাজ নিয়ন্ত্রণ করে।
• হরমোন জীবদেহের কোষে কোষে রাসায়নিক সংযোগ সাধন করে এবং রাসায়নিক বার্তা প্রেরণ করে।
অন্তঃক্ষরা বা এন্ডোক্রিন গ্রন্থির অবস্থান, নিসঃরণ ও ক্রিয়া (Position, Secretion and Functions of Endocrine Glands)
হরমোন শুধু অন্তঃক্ষরা গ্রন্থির কোষ থেকে নয় বরং দেহের বিভিন্ন অঙ্গে অবস্থিত কতকগুলো বিশেষায়িত কোষ থেকেও নিঃসৃত হয়।
অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিগুলো হলোঃ
ক. পিটুইটারি গ্রন্থি (Pituitary gland)
পিটুইটারি গ্রন্থিকে হরমোন সৃষ্টিকারী প্রধান গ্রন্থি বা প্রভু গ্রন্থি (Principal/Master gland) বলে। কারণ একদিকে, গ্রন্থি নিঃসৃত হরমোনের সংখ্যা যেমন বেশি, অন্যদিকে বিভিন্ন গ্রন্থির উপর এসব হরমোনের প্রভাবও বেশি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী কিন্তু সবচেয়ে ছোট গ্রন্থি।
অবস্থান ও আকৃতি : এ গ্রন্থি চোখের পিছনে মস্তিষ্কের পাদদেশে একটি ক্ষুদ্র বৃন্তের সাহায্যে যুক্ত থাকে। পিটুইটারি গ্রন্থি প্রায় ১ সে.মি. ব্যাস সম্পন্ন লালচে ধূসর, দেখতে মটর দানার মতো, ০.৫ গ্রাম ওজন বিশিষ্ট একটি গ্রন্থি।
পিটুইটারি গ্রন্থি ৩টি খন্ডে বিভক্ত, যথা-
ক. সম্মখ পিটুইটারি গ্রন্থি (Anterior pituitary gland) : এ গ্রন্থি থেকে ৬টি ট্রপিক হরমোন (tropic hormone) ক্ষরিত হয়। যে হরমোন অন্য অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিকে তার হরমোন ক্ষরণে উদ্বুদ্ধ করে সেগুলো হচ্ছে ট্রপিক হরমোন। এমন ৬টি ট্রপিক হরমোন সম্মুখ পিটইটারি গ্রন্থিতে উৎপন্ন ও জমা হয় এবং প্রয়োজনে রক্তবাহিকায় ক্ষরিত হয়ে সারা দেহে প্রভাব বিস্তার করে।
১. বৃদ্ধিপোষক হরমোন (Somatotropic Hormone, STH) : অস্থি ও কোমল টিস্যুর বৃদ্ধি, প্রোটিন সংশ্লেষ, গ্লাইকোজেনের সঞ্চালন ও চর্বি সঞ্চয়কে উদ্দীপ্ত করে।
২. থাইরয়েড উদ্দীপক হরমোন (Thyroid Stimulating Hormone, TSH বা Growth Hormone, GH): থাইরয়েড গ্রন্থিকে থাইরয়েড হরমোন সংশ্লেষ ও ক্ষরণে উদ্দীপ্ত করে।
৩. লুটিনাইজিং হরমোন (Luteinizing Hormone, LH) : নারীদেহে ডিম্বপাত, কর্পাস লুটিয়াম সৃষ্টি, এস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন সংশ্লেষকে উদ্দীপ্ত করে। পুরুষে টেস্টোস্টেরন ক্ষরণেও LH উদ্দীপ্ত করে।
৪. ফলিকল উদ্দীপক হরমোন (Follicle stimulating Hormone, FSH) : এর প্রধান কাজ হচ্ছে নারীদেহে ডিম্বাশয়ে ফলিকলের পূর্ণতা বা পরিপক্কতা দান করা এবং ইস্ট্রোজেন সংশ্লেষে উদ্দীপনা যোগানো।
৫. প্রোল্যাকটিন (Prolactin, PRL) : সম্মুখ পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে ক্ষরিত এ হরমোনের প্রভাবে স্তনগ্রন্থির বৃদ্ধি, দুগ্ধ উৎপাদন, অনাক্রম্যের প্রতি সাড়াদান, সন্তানের প্রতি বাৎসল্য ও পরিস্ফুটনের সময় নতুন রক্তকণিকা সৃষ্টিতে অবদান রাখে।
৬. অ্যাড্রেোনোকর্টিকোট্রপিক হরমোন (Adrenocorticotropic Hormone, ACTH): অ্যাড্রেনাল কর্টেক্সকে গ্লুকোকর্টিকয়েড (যেমন- কর্টিসল) স্টেরয়েড হরমোন ক্ষরণে উদ্দীপ্ত করে।
খ. মধ্য পিটুইটারি গ্রন্থি (Middle pituitary gland) : এ গ্রন্থি থেকে মেলানোসাইট স্টিমুলেটিং হরমোন (Melanocyte Stimulating Hormone – MSH) নিঃসৃত হয়। এ হরমোন মেলানোফোর কোষের বিস্তৃতি ঘটিয়ে ত্বক ও চুলের বর্ণ নিয়ন্ত্রণ করে।
গ. পশ্চাৎ পিটুইটারিটারি গ্রন্থি (Posterior pituitary gland) : এ গ্রন্থি থেকে দুটি হরমোন নিঃসৃত হয়।
১. অক্সিটোসিন (Oxytocin) হরমোন : স্তনের পেশি সংকোচন ঘটিয়ে দুগ্ধ ক্ষরণে সাহায্য করে ও প্রসবের সময় জরায়ুর সংকোচন তুরান্বিত করে।
২. ভ্যাসোপ্রেসিন (Vasopressin) বা অ্যান্টি ডাইইউরেটিক হরমোন (Anti Diuretic Hormone- ADH) : রক্তচাপ বৃদ্ধি করে ও বৃক্কের পানি শোষণ ক্ষমতা বাড়ায়।
খ. থাইরয়েড গ্রন্থি (Thyroid gland)
অবস্থান ও আকৃতি : ট্রাকিয়ার (শ্বাসনালি) উভয় পাশে অবস্থিত। প্রজাপতি আকৃতির গ্রন্থি।
নিঃসরণ : এ গ্রন্থি থেকে নিচে বর্ণিত ৩টি সক্রিয় হরমোন নিঃসৃত হয়।
১. ট্রাইআয়োডোথাইরোনিন (Triiodothyronin, T3) : মৌলিক বিপাক হারকে উদ্দীপ্ত ক প্রোটিন সংশ্লেষ ও প্রোটিন বিনাশ, গ্লুকোজ সংশ্লেষ, লাইপোলাইসিস প্রভৃতির হার বৃদ্ধি করে। এ হরমোন ভ্র্র্রূণ ও শিশুর পরিস্ফুটনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
২. থাইরক্সিন (Thyroxine, T4) : বিপাকীয় প্রক্রিয়ার হারকে নিয়ন্ত্রণ করে। এ হরমোন , প্রয়োজনীয় ভূমিকা পালন করে দৈহিক বৃদ্ধি নির্ধারণ করে। এ হরমোন প্রোটিন সংশ্রেয়।
৩. ক্যালসিটোনিন (Calcitonin, CT) : এটি অস্থি থেকে Ca2+ রক্তে স্থানান্তরে বাধা দেয়ার মাধ্যমে মাত্রা কমায়; বৃক্ককে ক্যালসিয়াম শোষণে বাধা দিয়ে মূত্রের মাধ্যমে ক্যালসিয়াম মোচন করিয়ে রক্তে এর সঠিক মাত্রা বজায় রাখতে সাহায্য করে; হাড়ে ক্যালসিয়াম সঞ্চয়ের মাধ্যমে রক্তে Ca2+ এর মাত্রা ঠিক রাখে ।
গ. প্যারাথাইরয়েড গ্রন্থি (Parathyroid gland)
অবস্থান : দুজোড়া প্যারাথাইরয়েড গ্রন্থি থাইরয়েড গ্রন্থির পিছনে এবং আংশিকভাবে থাইরয়েডের মধ্যে অবস্থিত
নিঃসরণ : প্যারাথাইরয়েড গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হরমোনটি প্যারাথাইরয়েড হরমোন (Parathyroid Hormone, PTH) বা প্যারাথরমোন (Paratharmone) বা প্যারাথাইরিন (Parathyrin) নামে পরিচিত।
ক্রিয়া : রক্তে Ca2+ এর পরিমাণ কমে গেলে। প্যারাথরমোন ক্ষরণ বৃদ্ধি পায়। PTH নিম্নোক্ত উপায়ে রক্তে Ca2+ এর পরিমাণ বাড়ায়।
PTH সরাসরি অস্থি থেকে Ca2+ কে রক্তে স্থানান্তর করার মাধ্যমে Ca2+ এর পরিমাণ বাড়ায় ।
বৃক্কের ডিস্টাল টিউবিউল-এ Ca2+ এর পুনঃশশাষণ বাড়ায়।
বৃক্কে Vitamin D3 কে সক্রিয় করে 1, 25 ডাই হাইঅক্সি কোলেক্যালসিফেরল এর রূপান্তর করে যা অন্ত্রে ক্যালসিয়াম এর শোষণ বাড়ায়। স্নায়ু উদ্দীপনা প্রবাহে ক্যালসিয়ামের গুরুত্ব অপরিসীম । তাছাড়া পেশির সংকোচন ও রক্ত জমাট বাঁধায়ও ক্যালসিয়ামের সঠিক মাত্রা প্রয়োজন রক্তে ফসফেটের মাত্রা কমিয়ে দিতে এবং ভিটামিন D-কে সক্রিয়করণে প্যারাথরমোন ভূমিকা পালন করে। ভিটামিন D-র অভাবে বাচ্চাদের রিকেটস (rickets) রোগ দেখা দেয়। বয়স্কদের হয় অস্টিওম্যালাসিয়া (osteomalacia)।
ঘ. অ্যাড্রেনাল বা সুপ্ৰারেনাল গ্রন্থি (Adrenal or Supra-renal gland)
অবস্থান ও আকৃতি : প্রতিটি বৃক্কের মাথায় টুপির মতো একটি করে মোট দুটি। গ্রন্থির বাইরের হলুদ অংশকে কর্টেক্স (cortex) এবং ভিতরের পিঙ্গল বর্ণের অংশকে মেডুলা (medulla) বলে। এদের ওজন ৩-৫ গ্রাম।
নিঃসরণ : অ্যাড্রেনাল গ্রন্থির উভয় অংশ থেকেই হরমোন নিঃসৃত হয় এবং এদের কাজও ভিন্ন।
কর্টেক্স নিঃসূত হরমোন (Hormones secreted from cortex)
অ্যাড্রেনাল কর্টেক্স থেকে তিন ধরনের হরমোন নিঃসৃত হয়। যথা-
১. গ্লুকোকর্টিকয়েড (Glucocoticocids) : শর্করা জাতীয় খাদ্যের বিপাক নিয়ন্ত্রণ করে ।
২. মিনারেলোকর্টিকয়েড (Mineralocorticoids) : খনিজ লবণের বিপাক নিয়ন্ত্রণ করে।
৩. যৌন কর্টিকয়েড (Sex hormone) : অ্যাড্রোজেন, ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন নামক যৌন হরমোনগুলো বর্ধন ও যৌন লক্ষণ প্রকাশে সাহায্য করে।
মেডুলা নিঃসৃত হরমোন (Hormones secreted from medula)
আড্রেনাল মেডুলা থেকে ৩টি হরমোন নিঃসৃত হয়।
১. অ্যাড্রেনালিন (Adrenalin) : এর অপর নাম এপিনেফ্রিন (Epinephrine)। যকৃতে সঞ্চিত গ্লাইকোজেন থেকে গ্লুকোজ অবমুক্ত করে বিপাকের হার বাড়িয়ে দেয়। এছাড়া হৃৎপিণ্ড ও ধমনির অনৈচ্ছিক পেশির সংকোচন নিয়ন্ত্রণ করে ভয়, আনন্দ ও শোক প্রকাশে বিশেষ ভুমিকা পালন করে।
২. নর অ্যাড্রেনালিন (Nor adrenalin) : এর অপর নাম নর এপিনেফ্রিন (Nor epinephrine)। দেহের অতিরিক্ত গ্লাইকোজেনে রূপান্তরিত করে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা এর কাজ।
৩. ডোপামিন (Dopamine) : এটি নিউরোট্রান্সমিটার হিসেবে কাজ করে।
ঙ. থাইমাস গ্রন্থি (Thymus gland)
বক্ষদেশে, হৃৎপিণ্ডের ঠিক উপরে এ গ্রন্থি অবস্থিত। ভ্রূণ অবস্থায় এর কাজ শুরু হয় এবং জন্মের সময় এবং জন্মের পরপরই সবচেয়ে সক্রিয় থাকে, মায়ের বুকের দুধ ভিন্ন অন্য খাবারে অভ্যস্থ হবার পরপরই এটি হ্রাস পেতে শুরু করে। ইম্যুন রেসপন্স (immune response) বিকাশে এ গ্রন্থি গুরুত্বপূর্ণ। এ গ্রন্থি বেশ কয়েকটি থাইমিন হরমোন (যথা- থাইমোসিন আলফা) তৈরি করে যা থাইমাসে T-কোষ তৈরিতে ভূমিকা রাখে।
চ. অগ্ন্যাশয়ের আইলেটস অব ল্যাঙ্গারহ্যান্স (Islets of Langerhans in Pancreas)
আকৃতি ও অবস্থান : অগ্ন্যাশয় একটি মিশ্রগ্রন্থি। বহিঃক্ষরা অংশের মধ্যে কিছু কোষ একত্রিত হয়ে বিক্ষিপ্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাপের মত কতক কোষগুচ্ছ একেকটি অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি সৃষ্টি করে। এগুলো আইলেটস অব ল্যাঙ্গারহ্যান্স। আবিষ্কারক ’auel Langerhans (1869) এর নামানুসারে এ কোষগুচ্ছ “আইলেটস অব ল্যাঙ্গারহ্যানস” নামে পরিচিত। এসব গ্রন্থিকোষের সম্মিলিত আয়তন মোট অগ্ন্যাশয় আয়তনের ১-২% । প্রতিটি দ্বীপগ্রন্থির কোষ দানাদার, বহুভূজাকার ও ক্তিবাহিকা সম্বলিত । আইলেটস অব ল্যাঙ্গারহ্যান্স চার ধরনের কোষে গঠিত। এটির ̶
• আলফা কোষ থেকে গ্লুকাগন
• বিটাকোষ থেকে ইনসুলিন
• ডেল্টা কোষ থেকে সোমাটোস্ট্যাটিন হরমোন নিঃসৃত হয়
• PP কোষ থেকে প্যানক্রিয়েটিক পলিপেপটাইড ক্ষরিত হয়
কাজ :
• ইনসুলিন রক্তে গ্লুকোজ বা শর্করার পরিমাণ হ্রাস করে।
• ইনসুলিনের অভাবে রক্তে গ্লুকোজ লেভেল বেড়ে গেলে ডায়াবেটিস রোগ হয়।
• গ্লুকাগন দেহে সঞ্চিত গ্রাইকোজেন ভেঙ্গে গ্লুকোজের পরিমাণ বৃদ্ধি করে।
• গ্লুকাগন দেহে সঞ্চিত গ্রাইকোজেন ভেঙ্গে গ্লুকোজের পরিমাণ বৃদ্ধি করে।
• সোমাটোস্ট্যাটিন, ইনসুলিন ও গ্লুকাগনসহ বিভিন্ন অগ্ন্যাশয়িক হরমোনের ক্ষরণ নিয়ন্ত্রণ করে।
• প্যানক্রিয়েটিক পলিপেপটাইড হরমোনের কাজ হলো খাদ্য গ্রহণের পর ক্ষরিত হয়ে ক্ষুধা হ্রাস করে।
ছ. গোনাড বা জননাঙ্গ (Gonad)
জননকোষ উৎপাদনকারী অঙ্গকে গোনাড বা জননাঙ্গ বলে। গোনাড দু’ধরনের- শুক্রাশয় ও ডিম্বাশয়। এগুলো অস্থিরূপী অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি নয় কিন্তু এসব অঙ্গের অভ্যন্তরীণ কিছু টিস্যু অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি হিসেবে কাজ করে। পুরুষ ও নারীদেহে যথাক্রমে শুক্রাশয় ও ডিম্বাশয় রয়েছে।
আলফা
বিটা
ডেলটা
সবগুলোই
শারীরবৃত্তীয় কাজে হরমোনের প্রভাব
১. পৌষ্টিকনালির অন্তঃক্ষরা কোষ থেকে নিঃসৃত গ্যাস্ট্রিন, সিক্রেটিন ও কোলেসিস্টোকিনিন হরমোন পরিপাক ক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট এনজাইমগুলোর ক্ষরণ নিয়ন্ত্রণ করে।
২. থাইরক্সিন, ইনসুলিন, গ্লুকাগন, গ্লুকোকটিকয়েড হরমোন শর্করা বিপাক করে।
৩. থাইরক্সিন হরমোন প্রোটিন, স্নেহদ্রব্য ও খনিজ আয়ন বিপাক এবং টেস্টোস্টেরণ ও ইস্ট্রোজেন হরমোন প্রোটিন। বিপাক নিয়ন্ত্রণ করে ।
৪. এপিনেফ্রিন, নরএপিনেফ্রিন, এড্রেনালিন হরমোন হৃৎক্রিয়া ও রক্তচাপ বৃদ্ধি করে।
৫. অ্যাড্রেনাল কর্টেক্স থেকে ক্ষরিত অ্যালডোস্টেরণ Na+ K + আয়নের সমতা রক্ষা করে।
৬. স্টেরয়েডধর্মী হরমোনগুলো প্রোটিন সংশ্লেষণে, গ্রোথ হরমোন ফ্যাটকে ভেঙ্গে শক্তি উৎপাদনে প্রভাব ফেলে।
৭. ADH হরমোন পানি শোষণ ও পানি সাম্যতা বজায় রাখে। বৃক্ক থেকে ক্ষরিত লোহিত রক্তকণিকা উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করে এরিথ্রোপোয়েটিন হরমোন।
৮. ইস্ট্রোজেন ঋতুচক্র ও স্তনগ্রন্থির বিকাশ নিয়ন্ত্রণ করে, প্রোজেস্টেরণ জরায়ুর প্রাচীরে নিষিক্ত ডিম্বাণু স্থাপন এবং গর্ভাবস্থায় স্তনগ্রন্থির বিকাশ ঘটায়, টেস্টোস্টেরণ শুক্রাণুজনন (spermatogenesis)-এ শুক্রাশয়কে উদ্বুদ্ধ করে।
৯. প্রসবের সময় রিলাক্সিন শ্রোণীদেশীয় লিগামেন্ট ও পেশির প্রসারণ ঘটিয়ে এবং অক্সিটোসিন জরায়ুর সঙ্কোচন ঘটিয়ে প্রসব কাজ ত্বরান্বিত করে।
১০. টেস্টোস্টেরণ, এস্ট্রোজেন ও গোনাডোকটিকয়েড হরমোন গৌণ যৌন বৈশিষ্ট্যের বিকাশ ঘটায়।
১১. গ্রোথ হরমোন, থাইরক্সিন, এস্ট্রোজেন, প্রোথ্যাকটিন সন্তান প্রসবকারী মায়ের স্তনগ্রন্থির বৃদ্ধি ও দুধ উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
মানবদেহের যে কোনো আচরণের রহস্য উদ্ঘাটনে বিস্মিত হতে হয় কতো নিখুঁত, সঠিক ও পরিমিত হরমোনের মিশ্রণে দেহ পরিচালিত হচ্ছে। এর জন্যে রয়েছে কতকগুলো সুনির্দিষ্ট অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি। জীবনের প্রত্যেক ধাপে বিভিন্ন উপায়ে নারী, পুরুষ ও শিশুদেহের দৈহিক ও মানসিক পরিবর্তনে হরমোনের প্রভাব রয়েছে।
নারীদের আচরণগত পরিবর্তনঃ
১. রজঃচক্র চলাকালীন সময় নারীর দেহের কিছু কিছু হরমোন ক্ষরণে তারতম্যের সৃষ্টি হয়। এর ফলে নারীদের মধ্যে পুরুষের সামনে নিজেকে আকর্ষণীয় করে তুলে ধরার প্রবণতা বেড়ে যায়, খাদ্য গ্রহণ কমে যায় ইত্যাদি। সাধারণত নারীর দেহে ডিম্বপাতের সময় এগিয়ে আসলে এই ধরনের আচরণ করে থাকে।
২. রজঃচক্র বন্ধকালীন সময় এগিয়ে আসলে ডিম্বাশয়ে প্রোজেস্টেরণ, এস্ট্রোজেন ও অ্যান্ড্রোজেন হরমোন কম মাত্রায় ক্ষরিত হয় । এই পরিবর্তনের ফলে দেখা যায় নারীরা অল্প কিছুতে রেগে যায়, তাদের ঘুম ঠিকমতো হয়। না, অনেকে আবার বিষণ্নতায় ভুগে থাকে।
৩. গর্ভকালীন সময়ে বিভিন্ন ধরনের হরমোন যেমন- HCG (Human Chorionic Gonadotropin), প্রোজেস্টেরণ, রিলাক্সিন ইত্যাদি হরমোন ক্ষরণে তারতম্যের সৃষ্টি হয়। এর ফলে দেখা যায় অনেকে অল্পতে রেগে উঠে, হঠাৎ করে কেঁদে ফেলে ইত্যাদি নানান পরিবর্তন দেখা যায়।
৪. অনেক সময় দেখা যায় সন্তান প্রসবের পর হরমোন ক্ষরণের তারতম্যের জন্য নারীরা নানান মানসিক রোগে ভুগেন। একে প্রসবোত্তর সাইকোসিস বলে।
পুরুষদের আচরণগত পরিবর্তন
১. অতিরিক্ত টেস্টোস্টেরণ হরমোন ক্ষরণের স্বভাবে হিংস্রতা সৃষ্টি হয় এবং শক্তি সামর্থ্য বৃদ্ধি পায়।
২. টেস্টোস্টেরণের পরিমাণ কমে গেলে বিষণ্নতায় ডুবে যায়।
৩. শুক্র নিবৃত্তি বা অ্যান্ড্রোপজ এর সময় কাছে চলে আসলে যৌন আকাঙ্ক্ষা কমে যায়।
৪.টেস্টোস্টেরণের পরিমাণ বেড়ে গেলে যৌন আকাঙ্ক্ষা বেড়ে যায়।
অনিয়ন্ত্রিত হরমোন ব্যবহারের ফলাফল ( Result of uncontrolled use of Hormone ) দেহ সচল, কর্মক্ষম রাখতে অতি অল্প ও নির্দিষ্ট পরিমাণ হরমোন দেহে প্রয়োজন হয়। কারও দেহে পরিমিত হরমোন। না হলে নানা জটিল অবস্থা দেখা দিয়ে জীবনকে দুর্বিসহ করে তুলতে পারে। এমন অবস্থায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের প ও দক্ষ ব্যবস্থাপনায় নির্দিষ্ট হরমোন ব্যবহার করতে হয়। হরমোনের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার কষ্টদায়ক জীবনের অবসান।। গালেও অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারটি উল্টো ফল বয়ে আনে। নিচে কয়েকটি প্রধান হরমোনের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের ফলাফল করা হলো।
১. বৃদ্ধি হরমোন : দেহকে স্থিতিশীল ও বৃদ্ধিসাম্য বজায় রাখতে গিয়ে অতিরিক্ত বৃদ্ধি হরমোন ব্যবহারের ফলে উচ্চ রিতাপ, রক্তে প্রচুর ফ্যাট, ডায়াবেটিস, সন্ধিব্যথা, হৃৎপিন্ড বড় হয়ে যাওয়ায় হার্ট ফেইলিউর এবং হাত, পা, মাথার হাড় সাভাবিক বড় হয়ে যাওয়া।
২. থাইরক্সিন : থাইরক্সিনের স্বল্পতা পূরণে যে সংশ্লেষিত হরমোন (Levothyroxine) ব্যবহার করা হয় তাতে বল থাইরয়েড হরমোন স্বল্পতাই পূরণ হয় না, সে সঙ্গে থাইরয়েড ক্যান্সার এবং গলগণ্ড প্রতিরোধেও সহায়ক হয়। কিন্তু অতিমাত্রায় ব্যবহার হলে যে সব জটিলতা দেখা দেয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে : ছদ্ম-গলগন্ড হতে পারে; ছাড়া দ্রুত হৃৎস্পন্দন, উদরীয় ব্যথা, চিন্তাগ্রস্ততা, খিটখিটে মেজাজ, ওজন কমে যাওয়া, ক্ষুধাবৃদ্ধি প্রভৃতি। অ্যালার্জিক ডিক্রিয়ায় শ্বাসকষ্ট, ঘন ঘন শ্বাস নেওয়া এবং মুখমন্ডল ও জিহ্বা ফুলে যায়। হার্ট ফেইলিউর এবং রক্তে ক্যালসিয়াম ও লফরাস মাত্রার অস্বাভাবিক পরিবর্তন ঘটে।
৩. এপিনেফ্রিন (অ্যাড্রেনালিন) : ফুসফুসের ভেতরে বাতাস চলাচলের নালি খুলতে, রক্তবাহিকা সংকীর্ণ করতে এবং বিভিন্ন মারাত্মক অ্যালার্জিক ক্রিয়ার বিরুদ্ধে কাজ করতে সংশ্লেষিত এপিনেফ্রিন ব্যবহৃত হয়। অতিমাত্রায় ব্যবহৃত হলে দেখা দেয় উচ্চ রক্তচাপ, সঙ্গে মাথাব্যথা, ঝাপসা দৃষ্টি, দুঃশ্চিন্তা, দ্বিধাদ্বন্ধ, বুকব্যথা, অনিয়মিত হৃৎস্পন্দন, হঠাৎ তা, কথাবলা বা হাঁটাচলায় ভারসাম্যহীনতা, ঘনঘন শ্বাস নেওয়া প্রভৃতি।
৪. টেস্টোস্টেরণ : এটি পুরুষের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হরমোন। এর স্বাভাবিক ক্ষরণে পুরুষ যৌনাঙ্গ সুগঠিত রাখে, চাঁখ যৌন বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ ঘটিয়ে পৌরুষ প্রদর্শন করে। বড়ি বা ইনজেকশনের মাধ্যমে টেস্টোস্টেরণের অভাব পূরণে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। কিন্তু এর অতিব্যবহারে প্রথমে দুর্বলতা, নিদ্রালুভাব, গায়ে ব্যথা, চামড়ায় জ্বালাপোড়া ভাব, মনোযোগহীনতা, হাত-পায়ের আঙ্গুল ঠান্ডা হয়ে আসা প্রভৃতি দেখা দেয়। পরে শুক্রাশয়ে ব্যথা, দ্রুত বা মন্থর হৃৎস্পন্দন, তিময় মলত্যাগ, মূত্রথলিতে ব্যথা, পিঠের দুপাশে বা মাঝখান ধরে ব্যথা, ডায়ারিয়া প্রভৃতি জটিল অবস্থার সৃষ্টি হয় বা কোনো কারণে দেহে অপর্যাপ্ত হরমোন উৎপন্ন হলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এস্ট্রোজেনবাহী বড়ি বা ইঞ্জেকশন দেন।
৫. এস্ট্রোজেন : এস্ট্রোজেন নারীদেহের গুরুত্বপূর্ণ হরমোন। পরিমিত এস্ট্রোজেন নারীদেহকে সুস্থ, সবল ও সুদর্শন ব্যবহারের পরামর্শ দেন। এসব সামগ্রীর অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে নারী বিভিন্ন জটিলতায় ভুগে, যেমন- স্তন দৃঢ় হয়ে যাওয়া, লিভার অতিরিক্ত রক্তস্রাব, মাথাব্যথা, মানসিক ভাবের পরিবর্তন, বমিভাব, ত্বকে ফুসকুড়ি, মূত্রের রং পরিবর্তন
৬. ইনসুলিন : আজকাল অনেকেই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে ইনজেকশনের মাধ্যমে ইনস্যুলিন নিয়ে জীবনযাত্রা অবসাদ, ঢুলুঢুলুভাব, মাথাব্যথা, ক্ষুধা, মনোযোগে ব্যর্থ হওয়া, বমিভাব, স্নায়ুদৌর্বল্য, ব্যক্তিত্ব পরিবর্তন, দ্রুত হৃৎস্পন্দন, রেখেছেন। কিন্তু এর ব্যবহার কঠোর নিয়ন্ত্রণে না থাকলে নতুন নতুন জটিলতায় ভোগার সম্ভাবনা থাকে, যেমন ব্যঘাত বিচনি, ত্বক ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া ইত্যাদি।